চরিত্রের রয়েছে সমাজে ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব৷ ভালো চরিত্র সমাজে ফুল হয়ে ফোটে, আর মন্দ চরিত্র কাঁটা হয়ে বিঁধে৷ সভ্যতা, নৈতিকতা ও মানবীয় সকল সৌন্দর্যের গোড়া হলো উত্তম চরিত্র৷
কোনো সমাজের মানুষের চরিত্র দেখেই ঐ সমাজের ব্যাপারে ভালো মন্দ-মন্তব্য করা যায় সহজে৷ যে সমাজের মানুষের পরস্পর লেনদেন ও উঠবসে সততা ও নৈতিকতাসহ চারিত্রিক গুণাবলি থাকে না—বুঝতে হবে সেই সমাজে পঁচন ধরেছে৷ তাই মানুষের চরিত্রের যখন অধপতন হয়, তখন সমাজের প্রতিটি শাখায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে৷ ইসলাম আমাদেরকে উত্তম চরিত্রে গুণান্বিত হতে এবং মন্দ চরিত্র পরিহার করতে বলে৷
উন্নত চরিত্র ও উত্তম আচার-ব্যবহারের গুরুত্ব কারো অজানা নয়। সুন্দর আচার-ব্যবহার দূরকে টেনে আনে কাছে। কাছের মানুষ হয়ে ওঠে আরো ঘনিষ্ঠ। পারস্পরিক হৃদয়ের বন্ধনে ছড়িয়ে পড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস। সুন্দর আচরণ এবং উত্তম গুণাবলি মানুষকে নিয়ে যায় বহু মানুষের উর্ধ্বে, অসীম উচ্চতায়—যে উচ্চতার সামনে সবাই মাথা নত করে দাঁড়ায় ৷
চারিত্রিক সৌন্দর্যের বিষয়টি শুধুমাত্র আমাদের পার্থিব জীবনকেই স্পর্শ করছে—তা কিন্তু নয়। বরং এর কল্যাণ পার্থিব জীবনের গণ্ডি ছাড়িয়ে পারলৌকিক জগতের সাথেও জড়িয়ে আছে। উত্তম আচরণে পাওয়া যায় অনেক সওয়াব। রাসুল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসিমুখে সাক্ষাৎ করাকেও বলেছেন সওয়াব ৷
মানুষের চারিত্রিক সংশোধনের আহ্বান, আচরণের সৌন্দর্য ধরে রাখার শিক্ষা ইসলামের অনন্য শোভা ও প্রতীক। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে মিশন বাস্তবায়নের জন্য এই পৃথিবীতে আগমন করেছেন, উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা বিধান তার অন্যতম। তিনি উত্তম চরিত্রের শ্রেষ্ঠ আদর্শ ছিলেন। আচার-ব্যবহারে ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। কখনো কাউকে কটু কথার মাধ্যমে হেয়প্রতিপন্ন করতেন না।
ছিলেন অনুপম চরিত্র, উত্তম গুণাবলি ও সার্বিক সৌন্দর্যের অধিকারী। আয়েশাকে (রা.) জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল প্রিয়নবীর চারিত্রিক গুণাবলি সম্পর্কে। তিনি উত্তরে বলেছিলেন,
“كَانَ خُلُقُهُ الْقُرْآنَ”
‘পবিত্র কোরআনই ছিল তার চরিত্র।’
(মুসনাদে আহমদ: ২৪৬০১)
অর্থাৎ পবিত্র কোরআনে বর্ণিত সব প্রশংসনীয় চারিত্রিক গুণাবলি দ্বারা তিনি ছিলেন সুসজ্জিত । আল্লাহ তায়ালা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্রের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দিয়ে ইরশাদ করেছেন عظيم إنّك لعليٰ خلقٍ
আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী।’ (সুরা ক্বলাম : ৪)
মূলতঃ সর্বোত্তম চরিত্রের প্রতিষ্ঠাকারী হিসেবেই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছিল। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই বলেছেন,
” إِنَّمَا بُعِثْتُ لِأُتَمِّمَ صَالِحَ الْأَخْلَاقِ “
‘আমি উত্তম চরিত্রের পরিপূর্ণতা সাধনের জন্যই প্রেরিত হয়েছি।’
(মুসনাদে আহমদ: ৮৯৫২)৷
তাই তো নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুরো জীবন উত্তম চরিত্রের সুরভিত উৎস। যে সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে হৃদয় থেকে হৃদয়ে এবং পৃথিবীজুড়ে মানব থেকে মানবে।
চারিত্রিক অবক্ষয় ও নির্বাসিত মানবতার এই পৃথিবীতে উন্নত চরিত্র এবং উত্তম গুণাবলির বিকাশ ইসলামের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। আজকের ‘উন্নত বিশ্বও’ উত্তম চরিত্রের শিক্ষায় ইসলামের কাছে চিরঋণী, যা অকপটে স্বীকার করেছেন ইউরোপের বহু মনীষী।
হাদীস শরীফে উত্তম চরিত্রের অসংখ্য ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে। প্রিয় নবীজির পবিত্র কণ্ঠে বারবার ঘোষিত হয়েছে উত্তম আচরণের কথা। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন,
إِنَّ مِنْ أَحَبِّكُمْ إِلَيَّ، وَأَقْرَبِكُمْ مِنِّي مَجْلِسًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَحَاسِنَكُمْ أَخْلَاقًا، وَإِنَّ أَبْغَضَكُمْ إِلَيَّ، وَأَبْعَدَكُمْ مِنِّي مَجْلِسًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ : الثَّرْثَارُونَ، وَالْمُتَشَدِّقُونَ، وَالْمُتَفَيْهِقُونَ “. قَالُوا : يَا رَسُولَ اللَّهِ، قَدْ عَلِمْنَا الثَّرْثَارُونَ، وَالْمُتَشَدِّقُونَ، فَمَا الْمُتَفَيْهِقُونَ ؟ قَالَ : ” الْمُتَكَبِّرُونَ
“তোমাদের যে ব্যক্তির চরিত্র ও আচরণ সর্বোত্তম সে-ই তোমাদের মধ্যে আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় এবং কিয়ামাত দিবসেও আমার খুবই নিকটে থাকবে। আর তোমাদের মধ্যে যারা আমার নিকট সবচেয়ে বেশি ঘৃণ্য এবং কিয়ামাত দিবসেও আমার নিকট হতে অনেক দূরে থাকবে তারা হলো : (১) বাচাল, (২) অশ্লীল বাকচারী ও (৩) অহংকারী। (তিরমিযি: ২০১৮)
অপর হাদিসে ইরশাদ হয়েছে :
إن الله كريمٌ يحبُّ الكرم، ويحب معاليَ الأخلاق، ويكره سَفْسافَها
‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা মহানুভব। তিনি মহানুভবতা পছন্দ করেন। উন্নত চরিত্রকে ভালবাসেন এবং নিচু আখলাককে ঘৃণা করেন।’
(মুসান্নেফে আব্দুর রাজ্জাক ১১/১৪৩)
উত্তম চরিত্র সাহাবায়ে কেরামকে শিখিয়েছেন নবীজি। সহাবায়ে কেরাম নবীজির স্বার্ণালী কথামালা যেমন শুনেছেন তেমন শিখেছেন। যেমনি দেখেছেন তেমনি ধারণ করেছেন। শিক্ষা-দীক্ষার এই সোনালী ধারা কেবল নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং প্রসারিত করেছেন পরবর্তীদের মধ্যে। নববী আদর্শের এ সৌরভ আলো জ্বালিয়ে যাচ্ছে মানুষের প্রাণে প্রাণে।
হাদীসে শরীফে উত্তম চরিত্রের অসংখ্য পুরস্কারের ঘোষণা এসেছে। উন্নত আচরণের এই গুণ যার মাঝে যত উত্তমভাবে থাকবে সে তত উত্তম হবে। নবীজি ইরশাদ করেন,
” إِنَّ مِنْ خِيَارِكُمْ أَحْسَنَكُمْ أَخْلَاقًا “.
‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সে যার আখলাক সবচেয়ে উত্তম।’
(বোখারি : ৩৫৫৯)
আম্মাজান হযরত আয়েশা রাযি. বর্ণনা করেন, নবীজিকে বলতে শুনেছি,
” إِنَّ الْمُؤْمِنَ لَيُدْرِكُ بِحُسْنِ خُلُقِهِ دَرَجَةَ الصَّائِمِ الْقَائِمِ “.
‘নিশ্চয় মুমিন তার উত্তম আচরণ দিয়ে স্পর্শ করতে পারে রাত জেগে ইবাদতকারী এবং দিবসজুড়ে রোযাদার বান্দার মর্যাদা।’
(আবু দাউদ : ৪৭৯৮)
এই উত্তম আখলাকের গুণ যার মধ্যে যত বেশি তার ঈমান ততবেশি পূর্ণ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
” أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ إِيمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا “.
‘মুমিনদের মধ্যে ঈমানের দিক থেকে
সে সবচেয়ে পূর্ণ, যার আখলাক সবচেয়ে উন্নত।’ (আবু দাউদ : ৪৬৮২)
উন্নত আখলাক মানুষকে নিয়ে যায় জান্নাতে। হজরত আবু হুরায়রা রাযি. বলেন, নবীজিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল – কোন জিনিস মানুষকে সবচেয়ে বেশি জান্নাতে প্রবেশ করাবে? ’ নবীজি উত্তরে বললেন,
” تَقْوَى اللَّهِ، وَحُسْنُ الْخُلُقِ “
‘ আল্লাহর ভয় এবং উত্তম আচরণ।’ (তিরমিযি : ২০০৪)
উত্তম চরিত্র ও আচরণের মাধ্যমে বান্দা মর্যাদার সোপানগুলো পেরিয়ে পৌঁছে যায় জান্নাতে। ইসলামে এতই গুরুত্ব উন্নত চরিত্রের।
হুসনে আখলাক মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত ও সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার ভিত্তি। মুমিন হয় উত্তম চরিত্রের অধিকারী; সে বদমেজাজী, বিদ্বেষ ভাবাপন্ন ও মানুষের সঙ্গে রুক্ষ আচরণকারী হয় না। প্রতিশোধ নেয় না অন্যায় আচরণের। সবাইকে সে ক্ষমা করে দেয় উদারভাবে। বিরূপ আচরণের মুখোমুখি হলেও উন্নত চারিত্রের সুবাস ছড়িয়ে দেয় চারপাশে ৷
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে উত্তম চরিত্রে গুণান্বিত হবার তৌফিক দান করুন ৷

previous post
next post
Facebook Comments