সংকলন
হুজাইফা-মাহমুদ
নির্মল জীবন

নির্জন বেহেশতের মুসাফির | হুজাইফা মাহমুদ

জানুয়ারির এই সময়টাকে কাশ্মীরের লোকজন বলে চিল্লাই কালান। মানে শীতের এক চিল্লা। ডিসেম্বরের শেষ দশক থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম দশ দিন পর্যন্ত যে ভয়াবহ শীতটা থাকে সেটা হলো চিল্লাই কালান। মধ্য জানুয়ারির এমন পড়ন্ত বিকেলে আমি চুপচাপ বসেছিলাম বানিহাল রেল স্টেশনে। বানিহাল রেল স্টেশন, যেখান থেকে কাশ্মীরের অভ্যন্তরীণ রেল যোগাযোগ শুরু হয়েছে।চারদিক বিশাল দানবীয় বরফাবৃত পাহাড় দিয়ে ঘেরা। পাহাড়ের একদম কোলে ছোট্ট ছিমছাম একটা স্টেশন। নির্জন, কোলাহল নেই, লোকজনও নাই তেমন। একেকটা ট্রেন চলে যাওয়ার পর পুরো স্টেশন ফাঁকা হয়ে যায়। পরবর্তী ট্রেন ছাড়ার কিছুসময় পূর্ব থেকে আবার লোক জমতে থাকে। আমি বেশ দীর্ঘ সময় বসে ছিলাম সেই নির্জন স্টেশনে।

 

প্রচণ্ড শীত সবকিছুকে জবুথবু করে রেখেছে। পড়ন্ত দুপুরে হালকা সূর্যের আলো তখনও মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে। সেই নরম আলো বরফাবৃত পাহাড়ের চূড়ায় গলে গলে পড়ছে। শ্বেতশুভ্র পাহাড়চূড়া সোনারং ধারণ করে তখন। আমি আমার ওভারঅলের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বসে আছি। নিতান্তই একা এক মুসাফির। পাহাড় চূড়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি ভাবছিলাম আমার খুব প্রিয় কাশ্মীরি কবি আগা শহীদ আলীর সেই বিখ্যাত কবিতাটির কথা, দ্য কান্ট্রি উইদাউট আ পোস্ট অফিস।

Again I’ve returned to this country

where a minaret has been entombed.

শহীদ আলির মতো, আমিও পুনরায় ফিরে এসেছি এমন এক দেশে, যেখানে সমাধিস্থ করা হয়েছে একটি মিনারকে।

ট্রেন যখন শ্রীনগর পৌঁছে ততক্ষণে সন্ধ্যার অন্ধকার গভীর হয়ে নেমে এসেছে, এবং ট্রেনও মোটামুটি যাত্রীশূন্য হয়ে পড়েছে। শ্রীনগর থেকে আরও প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে মাযহূমা স্টেশন, আমার গন্তব্য। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় রাত হয়ে এলো। আলো বিহীন আঁধার ঘেরা ছোট্ট সেই স্টেশনে দুইজন মাত্র যাত্রী নামলাম আমরা। অন্ধকারে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একটা সেন্ট্রি-রুম দেখা যাচ্ছে প্লাটফর্মের একপাশে, সেখান থেকে রাইফেল তাক করে আছে কোনো চৌকশ ফৌজি, এতটুকু ঠাহর করা যাচ্ছে। আরও দু’পা এগুতেই যেন ভূতের মতো আঁধার ফুঁড়ে সহসা উদয় হলো আরেকজন ফৌজি। রীতিমতো চমকে উঠলাম। চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করলো–

‘কাহাঁ জানা হ্যায়?’

বললাম, ‘যাকুরা।’

‘কাহাঁ সে আয়া?’

‘সাহারানপুর।’

‘কিস কে পাস?’

‘দোস্ত কে পাস।’

‘আইডি দিখাইয়ে।’

 

আইডি দেখিয়ে এবং আরও টুকটাক জেরা পর্ব সমাপ্ত করে স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলাম। কথা ছিলো সায়েম ভাই এখান থেকে রিসিভ করবেন। কিন্তু শেষমুহুর্তে এসে তিনি আটকে গেছেন জরুরি একটা কাজে, আসতে পারেননি। কিন্তু প্রতি পাঁচ মিনিট পরপর ফোন দিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন এবং দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। স্টেশনের বাইরেও ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমি আর আমার সহযাত্রী ব্যতীত আর কোনো প্রাণী নেই অত্র এলাকায়। তার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, তিনি বিহারের লোক, এখানে কাজ করেন। দু’জন মিলে হাঁটা শুরু করলাম, মেইন রোড পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ হেঁটেই যেতে হবে। কিন্তু দু কদম যাওয়ার পরই আমার সহযাত্রীর পথ আলাদা হয়ে গেলো। তিনি তার পথে চলে গেলেন। কাশ্মীরের রাতগুলো অদ্ভুত! এখানে রাতের অন্ধকার কেবল রক্ত জমাটকরা শীত আর ঘুটঘুটে অন্ধকারই বয়ে আনে না, সাথে আনে অপার্থিব ভূতুড়ে নির্জনতা আর প্রবল আতঙ্কের শিরশিরে অনুভূতি! এখানে প্রতিটি রাত কাটে ভয়ঙ্কর কোন দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে। রাত হলেই গোটা কাশ্মীর কোথায় যেন হারিয়ে যায়। একান্ত প্রয়োজন বা বিপদে না পড়লে কেউ রাস্তায় বেরোয় না এসময়ে। সন্ধ্যার অন্ধকার গিলে ফেলে সমস্ত কোলাহল, প্রাণচাঞ্চল্য, জীবনের স্রোত।

এমন অদ্ভুত শীতল আঁধার নির্জনতার ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেশ রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম। প্রচণ্ড ভয় লাগছে, কিন্তু তারচেয়েও বেশি ভালো লাগছে। শীতে হাত-পা কাঁপছে ঠকঠক করে। সামনে তাকালে বরফাচ্ছাদিত দৈত্যাকৃতির পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে, যেন পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। এক পা দু’পা করে হাঁটছি, আর বিবিধ ভাবনার স্রোতে ভাসছি। বিস্মিত হচ্ছি খুব, কী অদ্ভূত সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি আমি।

সেই অপার্থিব গম্ভীর নির্জন রাতের স্মৃতি প্রায়ই মনে পড়ে। নির্জনতাকে এতোটা গভীরভাবে খুব কমই উপলব্ধি করতে পেরেছি জীবনে৷

 

২.

আমার পুনঃপুন কাশ্মীর গমন এবং একে কেন্দ্র করে ঘনিভূত হয়েছে যত স্মৃতিকাতর ব্যাকুলতা আর আবেগ, এর পেছনের মূখ্য সবটাই নির্মল সুখস্মৃতি আর তুমুল আনন্দজাগানিয়া অনুভূতি নয়, ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনা ও পরিস্থিতির সম্মুখীনও হয়েছিলাম। রীতিমতো ভয়ঙ্কর ও আতঙ্কজনক স্মৃতিও আছে। মনে পড়লে এখনও গা শিউরে ওঠে।

সায়েম ভায়ের বাড়িতে পৌঁছার দুই-তিন দিন পরে তার এক মামা আমাদেরকে নিমন্ত্রণ জানান তাঁর বাড়িতে। জোর নিমন্ত্রণ, যেতেই হবে। এমনিতে কাশ্মীরের অভাবনীয় অতিথিপরায়নতা দুনিয়াজুড়ে বিখ্যাত, এর উপর আমি ছিলাম দেওবন্দের মেহমান। খুশিমনে রাজি হয়ে গেলাম। নতুন জায়গা, নতুন অভিজ্ঞতা হবে নিশ্চয়।

 

তারপর কোনো এক বিকেল হয় হয় দুপুরে আমরা রওয়ানা করলাম তাদের বাড়ির উদ্দেশে। খুব দূরে নয় অবশ্য–বিশ-বাইশ কিলোমিটার হবে। দুর্গম পথ হওয়াতে সময় কিছুটা বেশি লাগে। পুরোটা পথজুড়েই আপেল আর চিনার গাছের বাগান। শীতকাল, বাগানের সব পাতা ঝরে গেছে, দাঁড়িয়ে আছে কেবল সারিসারি গাছের কঙ্কাল। কেমন ধূসর, নির্জন আর বিষণ্ন সে-সব বাগান।

 

রাস্তা কিছুদূর গিয়েই ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠলো। পাহাড়ের গা বেয়ে প্যাঁচিয়ে কেবলই উপরে উঠে যাচ্ছে। দুই পাশে সাজানো-গোছানো আটচালা ঘরবাড়ি, মসজিদ, বিদ্যালয়, দোকানপাট। যত উপরে উঠছি তত শীত বাড়ছে আর জমাট তুষারের স্তরও নজরে পড়ছে চারপাশে। আরও কিছুদূর গাড়ি যাওয়ার পর রাস্তা শেষ হয়ে গেল। বাকি পথ উপরে এবং অমসৃণ মাটির। হেঁটে যেতে হবে।

 

আমরা খুশিমনে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলাম। পনের-বিশ মিনিট হাঁটার পরে উপস্থিত হলাম একটা চূড়ায়। সেখানে ছড়ানো-ছিটানো অল্প কয়েকটা ঘর মিলে একটা মহল্লা গঠিত হয়েছে, নাম হলো ‘মহল্লা গণিবাবা’। পরে জানা গেলো, ‘গণিবাবা’ নামে একজন পীর ছিলেন অত্র এলাকায়, তার নামেই নামকরণ।

 

এখানেই আমাদের মেজবানের বাড়ি। চূড়ার উপরে কিছুটা সমতল জায়গা আছে, সেখানে একদম ঢালুর পাশে তাদের ঘর। উচ্চতা বেশি হওয়ার কারণে এখানে ঠাণ্ডা বেশি। বেশি মানে ভয়ঙ্কর রকমের বেশি। ফলে, কিছুদিন আগের হয়ে যাওয়া তুষারপাতের তুষার এখনো গলে যায়নি; জমাট বেঁধে আছে। একমাত্র কাদাটে মাটির রাস্তাটা ছাড়া অন্যকোথাও মাটি নজরে পড়ে না।

 

আমরা বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলাম। মেজবানগণ উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। যথারীতি ড্রয়িং রুমে বসার সাথে সাথে মোটা কম্বল দিয়ে সযত্নে গা ঢেকে দিলেন, গনগনে আগুনের কাঙড়ি এনে দিলেন, সাথে ‘নমকিন’ চা।

 

আসার পরে মনে হলো, এখানে না-এলে জীবনে এক মহাশূন্যতা থেকে যেতো। স্বপ্নের মতো অতুলনীয় একটা জায়গায় এসে পড়েছি। দুনিয়ার সমস্ত কোলাহল আর ব্যতিব্যস্ততাকে দূরে ফেলে এই একটি গ্রাম পৃথিবী ছেড়ে পালিয়ে এসেছে!। এখানে কোলাহল নেই, কারো কোন ব্যস্ততা নেই, কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই। সবকিছুই ধীর, স্থির, প্রশান্ত আর তন্দ্রালু। যেন সবকিছু থেমে আছে এক আশ্চর্য জাদুর ঘোরে।

 

চারদিকে পত্রপল্লবহীন উদাস আপেলের বাগান আর সারি সারি চিনারের গাছ। তুষারের ঐশ্বর্য্যময় শুভ্রতা দিয়ে আবৃত জমিন। এখানে কোন মোটরকার নেই। ঘোড়া ও খচ্চরের পিঠে চেপে চলাচল করে লোকজন। ঘাস ও জ্বালানিকাঠের বোঝা টেনে নিয়ে যায় ঘোড়ার পিঠে করে। আঁকাবাঁকা মাটির পথটি নেমে গেছে একদম নিচে, তারপর আরও এক পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে অনেক উপরে।

 

ঘরের জানালা দিয়ে তাকালে চোখের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় যে পাহাড়টি, সেটি আরও উঁচু, আরও গভীর বরফে আবৃত। চিরসবুজ দেওদার গাছের জঙ্গল সে পাহাড়ে। এসব গাছের পাতা সব মৌসুমেই ঘন সবুজ, ঝরে না শীতকালেও৷ আর, দুই পাহাড়ের মাঝের উপত্যকা দিয়ে বয়ে গেছে এক বরফগলা নদী। তনুমন অবশ করে দেয় সে নদীর মোহনীয় আওয়াজ। এইসব বরফের ভূমি সন্ধ্যার ঘোলাটে অন্ধকারে কি বিষন্নতায় যে ভুগে, সেটা না দেখলে বুঝা যায় না।

গভীর নৈঃশব্দের ভেতর চারদিকে এত হাহাকার ছড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, যেন শতবর্ষের পুঞ্জিভুত বেদনার ভার নিয়ে একেকটা দিন অস্তমিত হয় এখানে।

 

রাতে আর বাইরে বের হওয়ার সুযোগ নাই। ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। তাপমাত্রা মাইনাস দশে নেমে এসেছে। তথাপি রাতের অন্ধকারে এই দৈত্যাকার বরফাবৃত পাহাড়গুলোকে কেমন দেখায়, সেটা দেখার জন্য আমি একবার বাইরে আসলাম। সে অনিন্দ্য দৃশ্য আমি কি ভুলতে পারবো! আধখানা চাঁদের সামান্য আলো গলে গলে পড়ছে বরফের উপর। অন্ধকার ভেদ করে ঠিকরে পড়ছে বরফের শুভ্রতা। এতটা মায়াময় আধো-অন্ধকার চাঁদের আলো আমি আর কোথাও দেখিনি।

 

তেমনই, পরদিন সকালে দেখলাম ভোরের উদিত সূর্যের কুসুমকোমল আলো ওই তুষারশুভ্র পাহাড়ের গায়ে এক আশ্চর্য সোনালী রং মেখে দিয়েছে। মনে হয় যেন স্বর্ণের প্রলেপ দেয়া হয়েছে পাহাড়টির গায়ে। এ-ও এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য!

কেমন এক ঘোরের ভেতর দিয়ে কেটে গেছে দুইটা দিন। কতকিছু করলাম, কত মানুষের সাথে পরিচয় আর হৃদ্যতা গড়ে উঠলো, কত অচিনপুরের মানুষ তাদের আন্তরিকতা আর হৃদয়ের উষ্ণতা দিয়ে স্মৃতির মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এখনো চোখ বন্ধ করলে স্পষ্ট দেখতে পাই সবকিছু, প্রতিটা মুহূর্তের দৃশ্যাবলি।

দিনের বড় একটা অংশ আমরা ওই উপত্যকার বরফগলা নদীর পাশে গল্প করে কাটিয়েছি। কখনো ছোট্ট লোহার ব্রীজটায় বসে, শীতের তন্দ্রালু সূর্যের নিচে বসে, আগুনের পাত্রে গা গরম করে, কত ইতিহাস আর কাহিনি যে শুনেছি! তন্ময় হয়ে শুনেছি বহমান স্রোতের স্বর্গীয় গুঞ্জণ, কলকল কলস্বর।

 

সায়েম ভায়ের বন্ধু-বান্ধবও আছে সে গ্রামে। তারাও এসে জুটলো আমাদের সাথে। দুয়েকজনের বাড়িতেও যাওয়া হলো। সে যাক।

 

একদিন থাকার ইচ্ছা নিয়ে আসলেও মেজবানদের জোরাজুরি আর আমার অতি ভাললাগার কারণে দুই দিন থাকা হলো। খুব খাওয়া-দাওয়া আর ঘোরা-ফেরা হলো। তৃতীয় দিন দুপুরের আগে আমরা রওয়ানা হলাম ‘কুপওয়ারা’ জেলার উদ্দেশে। সেখান থেকে ‘লোলাব ভ্যালি’। আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরির বাড়ি দেখতে যাবো। (লুলাব ভ্যালির সফরনামা আগেই লিখেছিলাম।) সেখান থেকে দুইদিন পরে আবার সায়েম ভাইদের বাড়িতে ফিরলাম এবং তখনই সেই ভয়ঙ্কর সংবাদটি জানতে পারলাম সায়েম ভাইয়ের বড় ভাই ওয়াহিদ বেগের মাধ্যমে।

 

তিনি জানালেন, আমরা সেই গ্রাম, মানে, মহল্লা গণিবাবা ছেড়ে বেরিয়ে যাবার একঘন্টা পরই তাদের বাড়ি সেনাবাহিনী ঘিরে ফেলে। চারদিকে ব্যারিকেড দিয়ে তারা প্রথমে ঘরের বাসিন্দাদেরকে বেরিয়ে আসতে বলে। তারপর পুরো বাড়িতে তন্নতন্ন করে তল্লাশি করে। ঘরের লোকদেরকে কঠোর জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হয়। এই বাড়িতে কারা এসেছিল, কোথা থেকে এসেছিল, কেন এসেছিল ইত্যাদি হাজারো রকমের সওয়াল। পুরো কাশ্মীরজুড়ে এরকম হাজারো গোয়েন্দা তৎপর আছে। কোনো এলাকায় নতুন মানুষ দেখলেই সেনাবাহিনীর কাছে সংবাদ চলে যায়। বিশেষ করে এই এলাকা যেহেতু পর্যটন এরিয়ার অন্তর্ভুক্ত না, তাই বহিরাগত লোকদেরকে এখানে তারা স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখবে এবং বরদাশত করবে না। এই গহীন গ্রামেরও প্রায় দেয়ালেই আর্মি ক্যাম্পের নাম্বার লিখে দেয়া আছে। যে কেউ চাইলে যখন-তখন সংবাদ পৌঁছাতে পারে।

 

তারা আমার পরিচয় দিলেন। সায়েম ভায়ের পরিচয়ও দিলেন। কিন্তু কথায় কাজ হচ্ছে না। তাদের দাবী হলো, যারা এখানে ছিল তাদেরকে ফোন করে এখানে আসতে বলো। ঘটনাক্রমে আমাদের উভয়ের কারো ফোনেই চার্জ ছিল না বিধায় ফোন বন্ধ। অগত্যা তারা এতটুকুতে মানলো যে, যেকোনোভাবে তাদের আইডেন্টিটি নিশ্চিত করো। তখন তিনি সায়েম ভায়ের বড় ভাইকে ফোন করে বিস্তারিত জানান। তিনি প্রথমে সায়েম ভায়ের পরচিয়পত্রের ছবি তুলে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠান। তারপর আমার রুমে গিয়ে ব্যাগ চেক করেন, এবং সৌভাগ্যক্রমে ব্যাগের পকেটে রাখা পাসপোর্টের ফটোকপি আর স্টুডেন্ট কার্ড পেয়ে যান। সেটার ছবি তুলে পাঠান। এতে তাৎক্ষণিকভাবে তারা কিছুটা আস্বস্ত হলেও, বলে গেলো, যেকোন সময় তোমাকে আবার ডাকতে পারি আমরা। তখন তাদেরকেও যেমনেই হোক উপস্থিত করতে হবে।

 

এই কাহিনী শুনে আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম। আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি। আর আমার কারণে আরও কত মানুষকে কি পরিমাণ পেরেশানিতে পড়তে হয়েছে, এটা ভেবেও খুব খারাপ লাগছিল। সায়েম ভাইরা নানাভাবে আমাকে অভয় আর সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। আমি তখনই কাশ্মীর ছেড়ে চলে আসতে চাইলে, তারা নিবৃত করেন এবং এটা নিয়ে কোনো চিন্তা না করতে বলেন। কিন্তু ঘটনার হালচাল এবং কাশ্মীরের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে এসব ঘটনার সাধারণ পরিণতি কী ঘটে, বা আমি সেখানে উপস্থিত থাকলে কী ঘটতে পারতো–সে-সব ভেবে আমার উৎকণ্ঠা বেড়েই চললো।

 

কাশ্মীরের পরিস্থিতির সাথে যাদের জানাশোনা আছে, তারা “ফেইক এনকাউন্টার” নামক একটা টার্মের সাথেও পরিচিত হয়ে থাকবেন। সে-নিয়ে আর কথা না বাড়াই। যেহেতু তারপরে তেমন কিছুই আর হয়নি। সেনাবাহিনীও আর তাদেরকে ডাকেনি। এই ঘটনার পরে আমি আরও কয়েকদিন ছিলাম। ধীরে ধীরে ভয়টা কেটে গেছে। ফলে মার্চ মাসে আবার যখন দিন কয়েকের সুযোগ পেলাম, তখনও সোজা কাশ্মীর গিয়ে উপস্থিত হলাম। এই জালিম রাষ্ট্রের সশস্ত্র ভ্রুকুটি আমাকে রুখতে পারেনি কোনভাবেই। হায়, আমার অলৌকিক নিয়তিই যেন এমন!

 

Facebook Comments

Related posts

নির্মল জীবন-১২ | ইমরান রাইহান

নির্মল জীবন-৪ | ইমরান রাইহান

সংকলন টিম

নির্মল জীবন-২ | ইমরান রাইহান

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!