সুফিয়ান সাওরী রাহিমাহুল্লাহ পর্ব-০১
ইমাম আযম আবু হানীফা রহ. বলেন, সুফিয়ান সাওরী যদি তাবিয়ীদের মধ্যে থাকতেন, সেখানেও তাঁর আলাদা মর্যাদা হতো।
তিনি আরো বলেন, আলকামা আর আসওয়াদ যদি সুফিয়ান সাওরীর সময় থাকতেন, তবে তারাও সুফিয়ানের দ্বারস্থ হতেন।
আবদুল্লাহ বিন মুবারক রহ. বলেন, আমার কাছে কারও প্রশংসা করা হলে যাচাই করে সকলকেই আমি তার সম্পর্কে শোনা প্রশংসার তুলনায় কম পেয়েছি। ব্যতিক্রম শুধুমাত্র সুফিয়ান সাওরী।
তাঁর সমসাময়িক সুফিয়ান বিন উয়াইনাহ রহ. বলেন, সুফিয়ান সাওরী নিজেই তার কোনো সমতুল্য দেখেননি।
ইউনুস বিন উবাইদ বলেন, আমি সুফিয়ান সাওরী থেকে উত্তম কাউকে পাইনি। একজন বলল, আপনি সাঈদ বিন জুবাইর, ইবরাহীম, আতা এবং মুজাহিদকে পেয়েও এই কথা বলছেন? তিনি বললেন, হাঁ, যা বলেছি তা বুঝেশুনেই বলেছি। সুফিয়ান সাওরী থেকে উত্তম কাউকে আমি পাইনি।
তিনি নিজের সম্পর্কে বলেন, আমি হৃদয়ে যা আমানত রেখেছি, আমার হৃদয় তার সাথে খিয়ানত করেনি। অন্য বর্ণনায়: আমি হৃদয়ে কিছু গচ্ছিত রেখে তা কখনো ভুলে যাইনি।
কে তিনি?
চৌদ্দশ বছরের প্রজন্ম পরম্পরায় ইলম আমলের চলমান এই ধারায় যে কাফেলা নেতৃত্ব দিয়েছে যুগে যুগে আলোর মশাল হয়ে, সে কাফেলার একেবারে সামনের সারিতে একঝলক ইমামের মাঝে তিনি অন্যতম বরেণ্য ইমাম। তিনি সুফিয়ান সাওরী রাহিমাহুল্লাহ।
ইলমুল হাদীস ও অন্যান্য ইলমে ছিলেন ইমাম। তিনি ছিলেন সর্বজনবিদিত দীনদার, তাকওয়ার অধিকারী এবং হাদীস গ্রহণে নির্ভরযোগ্য। মুজতাহিদ পর্যায়ের ইমাম।
মিহরান রাযী বলেন, আমি সুফিয়ান সাওরী থেকে বিভিন্ন অধ্যায়ের হাদীস লিখেছিলাম। পরে এক সময় সেখান থেকে ‘কিতাবুদ দিয়াত’ হারিয়ে ফেলে ঘাবড়ে গেলাম। পুরো ঘটনা সুফিয়ানকে জানালে তিনি অভয় দিয়ে বললেন, আমাকে অবসর পেলে মনে করিয়ে দিও। আমি আবার লিখিয়ে দেব। হজ্জের সফরে দুজনই ছিলেন একসাথে। সুফিয়ান তখন তাওয়াফ করে শুয়েছেন। তখন আমি তাকে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিলাম। তিনি অধ্যায়ের পর অধ্যায় এভাবে সম্পূর্ণ কিতাবই মুখস্থ লিখিয়ে দিলেন।
৯৭ হিজরী (৭১৮ ঈসায়ীতে) জন্মগ্রহণ করেন। জন্ম ও বেড়ে ওঠা কুফায়। শাসনভার নিতে অস্বীকৃতি জানানোয় কুফা থেকে পলায়ন করে মক্কা ও মদীনায় ছিলেন অনেকদিন। এরপর সেখান থেকে লুকিয়ে বসরায় গিয়েছেন আর সেখানেই ১৬১ হিজরী মোতাবেক ৭৭৮ ঈসায়ীতে ইনতেকাল করেছেন। ‘আল জামিউল কাবীর’ ও ‘আল জামিউস সাগীর’ নামে রয়েছে তাঁর হাদীসের দু’টি সংকলন।
প্রসিদ্ধ ইমাম আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন, আমি তার মজলিসে বসে হাদীস শুনতে শুনতে মজলিস শেষে মনে হতো, তার থেকে নেয়ার মত আর কোনো ইলম বাকি নেই। পরে অন্য মজলিসে বসে দেখতাম, তিনি আজ সম্পূর্ণ নতুন হাদীস শোনাচ্ছেন যা আমি কখনো শুনিনি। তখন আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম, তাঁর ইলমের বড় এক অংশ এখনো আমার না-শোনাই রয়ে গেছে।
ইবরাহীম বিন আবুল লাইস আশজায়ীর সূত্রে বলেন, আমি সুফিয়ান সাওরী থেকে ত্রিশ হাজার হাদীস শুনেছি।
ইলম হাসিলের সূচনা
পরিবার থেকেই তিনি লাভ করেন ইলম হাসিলের অদম্য আগ্রহ। বাবা সাঈদ বিন মাসরুক হলেন হাদীসের নির্ভরযোগ্য রাবী, কমবয়সী তাবেয়ীদের অন্তর্ভুক্ত। শা’বীর শাগরেদ। হাদীসের প্রসিদ্ধ ছয় কিতাবের প্রতিটিতেই তাঁর বর্ণিত হাদীস রয়েছে।
উমর ও মুবারক দুই ভাইই বাবার হাদীসের শাগরেদ। প্রিয় আম্মাও ছিলেন সকল সন্তানের জ্ঞান আহরণের প্রতি ব্যাকুল আগ্রহী। তিনি বলেন, বাছাধন! ইলম অন্বেষণ করতে থাকো। আমার এই চরকা দিয়েই তোমার খরচ নির্বাহ করব।
তিনি ইলম অর্জন করতে শুরু করেন বাবা মাসরুকের কাছ থেকে। এরপর তিনি অসংখ্য শায়খের কাছে ইলম শিখতে যান।
প্রসিদ্ধ আছে, তাঁর শায়েখের সংখ্যা প্রায় ছয়শ, যাদের মধ্যে বয়স্ক শায়েখগণ সরাসরি আবু হুরাইরা রাযি., জারীর রাযি. এবং আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি.-এর মত প্রখ্যাত সাহাবীদের থেকে হাদীস গ্রহণ করেন। সম্ভবত সাহাবীদের কাছ থেকে এক মাধ্যমে হাদীস গ্রহণ করার কারণেই তার কাছ থেকে তাঁর অনেক শায়খ হাদীস গ্রহণ করেন।
সুফিয়ান সাওরী রহ. এর যুগ ছিল বয়স্ক তাবেয়ীদের শিক্ষাদানের যুগ। ফলে অসংখ্য শায়খের কাছ থেকে হাদীস অর্জন করতে চাইলে প্রয়োজন পড়ত দীর্ঘ সফরের ও বেশ সময়ের। সে সময়ে সুফিয়ান সাওরী রহ. হাদীসের জ্ঞান অর্জন করেন প্রায় ছয়শ জন শায়খের কাছ থেকে।
ফলে তার শাগরেদ যে বিপুল সংখ্যক হবেন, তা খুব সহজেই অনুমেয়। বরং শুধু সে শায়খদের নামের তালিকাই বেশ দীর্ঘ, যাদের কাছ থেকে তিনি হাদীস শিখেছেন পরে একসময় তারাই শাগরেদ সুফিয়ানের কাছ থেকে হাদীস গ্রহণ করেছেন।
ইমাম যাহাবী রহ. বলেন, সুফিয়ান সাওরী ছোটকাল থেকেই উচ্চপ্রশংসার অধিকারী ছিলেন তিনটি কারণে। ১. তার অসম্ভব ধী-শক্তি, ২. হিফযে হাদীসের ব্যাপ্তি এবং ৩. তিনি হাদীস বর্ণনা শুরু করেন একদম অল্প বয়সেই।
ইয়াহইয়া বিন আইয়ুব আবুল মুসান্নার সূত্রে বলেন, মারওতে লোকজন বলাবলি করছিল, সাওরী এসেছেন সাওরী এসেছেন। আমি তাকে দেখতে বের হলাম। দেখি, এক বাচ্চা ছেলে যার এখনো গালে ঠিকঠাক দাড়ির পশমই ওঠেনি। অথচ হাদীসের জগতে তখনই তিনি কতটা প্রসিদ্ধি লাভ করে ফেলেছেন!
এখানে শুধু তাঁর সে শাগরেদদের নাম উল্লেখ করছি, যারা হাদীস বা ফিকহ অথবা উভয় শাস্ত্রে ইমাম হিসেবে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন।
আবু হানিফা, সুলাইমান আ’মাশ, ইবনু জুরাইজ, জা’ফার সাদিক, আওযায়ী, ইবনু আবি যি’ব, মিস‘আর, শু’বা, মা’মার।
আবু ইসহাক ফাযারি, আসবাত বিন মুহাম্মদ, ইবনু উলাইয়াহ, যুহাইর বিন মুআবিয়া, সুফিয়ান বিন উয়াইনাহ, আবু দাউদ তয়ালিসি, আবদুল্লাহ বিন মুবারক, আবদুল্লাহ বিন নুমাইর, উবাইদুল্লাহ আশজায়ী, আলী বিন জা’দ, আলী বিন হাফস মাদায়িনী, ইমাম মালিক বিন আনাস, হারুন বিন মুগীরা, প্রসিদ্ধ হাফিযুল হাদীস ওকী বিন জাররাহ, ইয়াহইয়া আল কাত্তান।
বড়দের সবকিছুই বড়
এত বড় ও প্রসিদ্ধ ইমাম হয়েও সুফিয়ান সাওরী রহ. ছিলেন সজাগ ও সতর্ক মানুষ। দরসে ও মজলিসে তিনি শাগরেদদের খেয়াল করতেন। কেউ নিয়মিত চুপচাপ থাকলে বা প্রশ্ন করতে ইতস্তত করলে তিনি নিজ থেকেই কথা বলে তাকে স্বাভাবিক করতেন।
মজলিসে একজন নিয়মিত আসত কিন্তু কোনো কথা বলতো না। একবার সুফিয়ান রহ. নিজেই তার কথা শোনার জন্য তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হে যুবক, আমাদের পূর্বপুরুষগণ তেজী ঘোড়ায় চড়ে অনেক সামনে চলে গেছেন। এদিকে আমরা পড়ে আছি আঘাতপ্রাপ্ত গাধার পিঠে। কী অবস্থা হবে আমাদের? যুবক উত্তর দিলো, যদি আমরা ঠিক পথেই এগুতে থাকি, তাদেরকে খুব দ্রুতই ধরে ফেলতে পারব।
তিনি বলেন,
তিন ক্ষেত্রে আল্লাহর ক্রোধ থেকে বেঁচে থাক। ১. তিনি তোমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তাতে শিথিলতা প্রদর্শন করা থেকে। ২. তিনি তোমার জন্যে যে রিযিক বণ্টন করেছেন তাতে তোমাকে অসন্তুষ্ট অবস্থায় দেখা থেকে। ৩. তুমি দুনিয়ার কিছু কামনা করে পাচ্ছ না এবং এ কারণে তোমার রবের উপর তুমি অসন্তুষ্ট, এমন হওয়া থেকে।
শারীক বলেন, এক ব্যক্তি এসে সুফিয়ান সাওরীর নিকট উপদেশ কামনা করল। তিনি বললেন, এই দুনিয়ায় যতদিন থাকবে সে হিসেবে কাজ করো। আর আখিরাত শান্তির স্থায়ী আবাস হিসেবে সেখানের জন্য আমল কর।
বি.দ্র. পরবর্তী পর্বগুলো আপলোড দেয়ার পর কমেন্টে লিঙ্ক দিয়ে দেয়া হবে ইনশা্আল্লাহ।
#সালাফ_পরিচিতি