সংকলন
সালাফ পরিচিতি

আতা ইবনে আবি রবাহ রহঃ পর্ব -১ | ইব্রাহিম বিন হানিফ

চলুন আমরা ৯৩ হিজরির জিল হজ্জের শেষ দশক থেকে একটু ঘুরে আসি…

এই তো পৃথিবীর নানান প্রান্ত হতে আগত আল্লাহ প্রেমি তাওহিদী জনতায় তরঙ্গময় হয়ে উঠেছে বাইতুল্লাহ। কেউ এসেছে পায়ে হেটে, কেউবা আবার ঘোড়ায় চড়ে। নানা রঙ্গের, নানান দেশের, আরবি আর আজমি, রাজা আর প্রজা সহ সকল আবালবৃদ্ধবনিতার এক মহা সমাবেশ। অনেক স্বপ্ন, অনেক চাওয়া নিয়ে আপন রব্বের কাছে ছুটে এসেছে সবাই। হৃদয়ে আল্লাহর ভয়, মুখে মুখে কলরবিত প্রাণবন্ত তালবিয়া।

এই তো এখানে খলিফাতুল মুসলিমীন, পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর বাদশা, সুলাইমান ইবনে আব্দুল মালিক। খালি পায়ে খালি মাথায় তাওয়াফ করছে। পরনে একটা লুঙ্গি আর গায়ে জড়ানো একটা চদর। অন্যান্য প্রজাদের যে হালত বাদশারো একই হলত।

তার পিছন পিছন হাঁটছে গোলপের পাপড়ির মত সুন্দর, চাঁদের কিরণের মত ধবধবে তারই দুই ছেলে। এভাবে শেষ করলেন তাওয়াফ। অতপর কাছের একজনের দিকে ঘুরে জানতে চাইলেন, তোমাদের সাথী কোথায়? জবাবে তিনি হারাম শরীফের পশ্চিম দিকে ইশারা করে বললেন, তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছেন। খলীফা আস্তে ধীরে সদলবলে সেদিকে এগিয়ে যেতে ঔদ্ধত্য হলেন । পার্সনাল গার্ড টিম মানুষের ভীর ঠেলে পথ করে দেয়ার জন্য প্রস্তুত হতেই তিনি তাদের বারণ করে বললেন, “এটা তো এমন এক জায়গা যাতে রাজা প্রজা সমান। এখানে কবুলিয়্যাত আর তাক্বওয়া ছাড়া কারো কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই।

” উষ্কখুষ্ক চুলের, ধুলামলীন দেহের কত মানুষ এখানে এতই বেশি শ্রেষ্ঠত্ব কভ করেছে যা পৃথিবীর কোন বাদশার নসীবে জুটেনি।

পুনারায় কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির দিকে ছুটলেন। শায়েখ দীর্ঘ সময় ধরে নিবিড় সালাতে মগ্ন।ডুবে আছেন রুকু সেজদার শীতল পরশে। সমভেত জনতা বসে আছেন চার পাশে তার মোবারক সান্নিধ্যের আশায়। বাদশার চাঁদের মত দুই সন্তান সবার সাথে অপেক্ষায়। দেখবেন কে এই ব্যক্তি যার অপেক্ষায় স্বয়ং বাদশাহ উপস্থিত হয়েছেন। শায়েখের কাছে আসতেই বলকদ্বয়ের চোখ বিস্ফারিত হলো। এতো দেখি এক নিগ্রু বুড়ো। কালো তার চেহরা, কুঁকড়া কুঁকড়া চুল আর মোটা বোঁচা নাক। যখন তিনি বসেন দেখা যায় যেন কালা একটা কাউওয়া!!

শায়েখ আস্তে ধীরে নামাজ শেষ করে ডান দিকে ফিরলেন। এদিকেই বসা ছিলেন বাদশাহ সুলাইমান ইবনে আব্দুল মালিক।তিনি সালাম দিয়ে মৃদু স্বরে শায়েখকে সম্ভাষণ জানালেন। শায়েখো সালামের উত্তম জবাব দিলেন।

এবার বাদশা একেক করে হজ্জের মানাসিক বা মাসায়েল জানতে চাইলেন। তিনি এমন বিশদভাবে উত্তর দিচ্ছিলেন যে, প্রশ্ন করার আরো কোন জায়গা থাকছিল না। একে একে সব প্রশ্ন শেষে বাদশা তার সন্তান সহ মাসআর দিকে রওনা হলেন। সাফা মরওয়ায় সায়ী করা অবস্থায় হঠাৎ বিকট শব্দে ধ্বনিত হলো, এই অঞ্চলে আতা ইবনে আবি রবাহ ছাড়া কেউ কোন ফতওয়া দিবে না। কারো কাছ থেকে কোন ফতওয়া চাওয়া যাবে না। যদি তাকে না পাওয়া যায় তাহলে আব্দুল্লাহ ইবনে আবি নাজীহ..

এই ঘোষণা শোনে বাদশাহর ছেলে দুইজন দীর্ঘ সময়ের বিষ্ময় প্রকাশের সুযোগ পেলো। জানতে চাইলো বাবার কাছে, বাবা! আমিরুল মু’মিনীনের ঘোষক এ কী ঘোষণা করছে? অথচ আমরা এমন এক ব্যক্তির কাছে ফতোয়া নিলাম যে বাদশাহর তা’জীমই বুঝে না!!

মৃদু হেসে বাদশাহ বললেন, তোমরা যে শায়েখকে দেখেছো, যার সামনে বিনয়নম্র হয়ে আমরা বসে ছিলাম তিনিই মূলত হারাম শরীফের একমাত্র স্বিকৃত মুফতী আতা ইবনে আবি রবাহ!! আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ এর সুযোগ্য উত্তরসূরী!!

অতপর নিজ বাহনের পিছনে বসিয়ে শন্তানদ্বয়কে নাসীহা করে বললেন, প্রিয় বৎস! এলম অর্জন করো।কারণ এলমের কারণে নাখাস্তা মানুষো হয়ে যান সর্বোচ্চ মর্যাদাশীল, অলস, অথর্ব হয়ে যান সতর্ক মানুষ, আর দাশরাও হোন বাদশাহর মাকামে উন্নীত।

এলমের বিষয়ে সুলাইমান ইবনে আব্দুল মালিক মোটেও বাড়িয়ে বলেননি। কারণ এই আতা ইবনে আবি রবাহই শৈশব ছিলেন মক্কার এক মহিলার দাশ। কিন্তু নিগ্রু এই বালকের উপর আল্লাহর বর করম যে, সে শৈশবকাল থেকেই এলমের পথ ধরেছেন। নিজের প্রতিদিনের সময়কে ভাগ করেছেন তিনটি ভাগে।
একভাগ তিনি নিজ মনিবার সেবা করতেন যতটা সুন্দর করে সেবা করা যায়।

দ্বিতীয় ভাগে একান্তে আপন রব্বের এবাদত করতেন যতটা গভীর ও নিবিড়ভাবে এবাদত করা যায়।
আর শেষ ভাগ অন্বেষণ করতেন জীবিত সাহাবয়ে কেরামের এলমের স্বচ্ছ উৎস্বরণ থেকে মর্যাদার এলম। আবু হুরায়রা, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের প্রমুখ বড় বড় সাহবিদের মোবারক সান্নিধ্য ধন্য হোন তিনি। এলম, ফিকহ ও হাদিসে নববীর অর্জনে সিনাহ ভরে যায় তার।

মনিবাহ যখন অনুভব করলেন গোলামের এলম পিপাসা, মুক্ত করে দিলেন। তিনি এলমের একনিষ্ঠ তালিব হয়ে গেলেন।বাইতুল্লাহ কে তিনি বানিয়ে নিলেন, বসবাসের বাড়ী,পড়ার মাদরাসা, এবং এবাদতের মসজিদ। এমনকি ঐতিহাসিকগণ বাধ্য হয়েই লিখেছেন, বাইতুল্লাহ হলো দীর্ঘ বিশ বছরের জন্য আতা ইবনে আবি রবাহ এর বিছানা!!

Facebook Comments

Related posts

ওয়াহাব বিন মুনাব্বিহ রহিঃ | ইব্রাহিম বিন হানিফ

মদিনার ফকিহ সাঈদ ইনবুল মুসাইয়েব রহ. | ইমরান রাইহান

আমের ইবনু শুরাহবিল | মাহদি হাসান

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!