সংকলন
নেকীর বৃক্ষটির পরিচর্যা নিন
আত্মশুদ্ধি মাহদি হাসান লেখক

নেকীর বৃক্ষটির পরিচর্যা নিন | মাহদি হাসান

১.

ফজরের নামাজ হয়ে গেছে। মদীনার পরিবেশ গায়ে মেখে আছে ফজর পরবর্তী পরিবেশের পবিত্র স্নিগ্ধতা। এমনি এক সময়ে মুখে আল্লাহ আল্লাহ জপতে বিধবা বৃদ্ধার ঘরের দরজায় কড়া নেড়েছেন সাহাবি। বৃদ্ধা দরজা মেলতেই সাহাবি তাকে বললেন, মা, আমি এসেছি আপনার ঘরের কাজগুলো করে দেয়ার জন্য।

বৃদ্ধা বললেন, প্রতিদিন যে লোকটি এসে আমার ঘরের কাজ করে দিয়ে যায়, সে তো ইতিমধ্যে করে দিয়ে গেছে।

সাহাবি তাজ্জব বনে গেলেন। ভেবেছিলেন সবার আগে এসে বৃদ্ধার ঘরের কাজগুলো করে দিয়ে এই নেক-আমলের সওয়ার টুকে নিবেন তাঁর পুণ্যের ঝুলিতে। কিন্তু কোনো এক ভাগ্যবান আগেই কুড়িয়ে নিয়ে গিয়েছেন এই অমূল্য সওয়াব।

সাহাবি পরদিন আরো ভোরে গেলেন। ফজরের আজানের সময়েই। গিয়ে আবারো কড়া নাড়লেন বৃদ্ধার ঘরের দরজায়। করলেন সেই একই আবেদন। এদিনও বৃদ্ধা মহিলাটি গতদিনের মতোই জবাব দিলেন।

তৃতীয় দিন সাহাবি বৃদ্ধার বাড়িতে গেলেন তাহাজ্জুদের সময়ে। যখন আল্লাহর কিছু প্রিয় বান্দা নিদ্রা থেকে জেগে উঠে প্রভুর প্রার্থনায় নিরত। সাহাবি মনে মনে নিশ্চিন্ত আজ। ভাবছেন, আজ বুঝি কেউ তাঁকে টপকে যেতে পারবে না। আজ তিনি বৃদ্ধার বাড়ির কাজগুলো করে দিয়ে ঠিকই সমৃদ্ধ করে নিবেন নিজের নেক-আমলের ঝুলি। নিশ্চিন্তমনে ঘরের দরজায় কড়া নাড়লেন তিনি। কিন্তু প্রতিদিনের মতো আজও একই উত্তর পেলেন বৃদ্ধা মহিলাটির কাছ থেকে। সাহাবি যারপরনাই আশ্চর্যান্বিত হলেন।

পরদিন রাতে তিনি ওৎ পেতে রইলেন বৃদ্ধার বাড়ীর সম্মুখে এক ঝোপের আড়ালে। দেখতে চান কে সেই সৌভাগ্যবান। যিনি প্রতিদিনই তাঁকে টপকে যাচ্ছেন। হাজার প্রচেষ্টাও সত্ত্বেও যাকে তিনি অতিক্রম করতে পারছেন না। শেষ রাতের দিকে দেখতে পেলেন পা টিপে টিপে সন্তর্পণে বুড়ীর বাড়ির দিকে আসছেন কেউ একজন। সাহাবি ভাবলেন এই তো সুযোগ। এখনই তাঁকে ধরতে হবে। এই ভেবে তিনি চকিতে পথরোধ করে দাঁড়ালেন সেই সাহাবির। কিন্তু তাঁর চেহারা দেখে তিনি হয়ে গেলেন হতবাক।

প্রথম সাহাবিটি কে জানেন? উমর রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। যাকে উদ্দেশ্য করে প্রিয় নবীজি বলেছিলেন, ‘আমার পরে যদি কোনো নবী হতো তবে উমর হতো সেই নবী’। কিন্তু এত বড় মর্যাদাবান হয়েও উমর কখনো টপকে যেতে পারেননি আরেক মহান সাহাবিকে। গারে সওরের কঠিন দিনে যে সাহাবিকে প্রিয় নবীজি বলেছিলেন,

‘চিন্তা করবেন না। আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’। উমর অর্জন করেছিলেন নবীজির পরবর্তী হওয়ার মর্যাদা। কিন্তু সেই মহান সাহাবি অর্জন করেছিলেন নবীজির সাথে থাকার মর্যাদা। খুব সম্ভবত আপনারা ধরেই ফেলেছেন কার কথা বলতে যাচ্ছি আমি। খলিলুর রাসুল, রাসুলের বন্ধু আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর কথাই বলছি আমি। আমাদের গল্পের দ্বিতীয় সাহাবিটি তিনিই। যাকে হাজার চেষ্টা করেও কখনো টপকে যেতে পারেননি আরেক মহান সাহাবি উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু।

২.

মুখোমুখি দুই মহান সাহাবি। আবু বকর এবং উমর। দুজনই মর্যাদার দিক দিয়ে এ উম্মাহর শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। তখন মদিনার মাটি ছিল প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পদধূলি শূন্য। তিনি সাড়া দিয়েছেন রফিক আলার ডাকে। তাঁর শূন্যস্থানে মুসলিম বিশ্বকে ইনসাফ এবং ইহসানের বারিধারায় সিক্ত করছিলেন খোলাফায়ে রাশিদার প্রথম খলিফা খলিফাতুল মুসলিমীন আবু বকর। যিনি ছিলেন কুরআনে বর্ণিত ‘রুহামাউ বাইনাহুম ওয়া আশিদ্দাউ আলাল কুফফার’ এর উত্তম দৃষ্টান্ত। খলিফাতুল মুসলিমীন আবু বকরকে দেখে উমরের বিস্ময়ের অন্ত রইল না। তিনি বিস্ময়ভরা কণ্ঠে খলিফাকে বললেন, সারাদিনের এত কষ্টের পর আবারো কেন কষ্ট করে এসেছেন আপনি? এসব ছোটখাটো কাজের জন্য আমরা কি নেই?

উমরের প্রশ্নের উত্তরে আবু বকর যে জবাব দিয়েছিলেন সেটিই আমাদের জীবন চলার পাথেয়। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘কেন উমর? আমার কি আখিরাতের প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই?’

৩.

আল্লাহু আকবার! রাসুলের দুই মহান সাহাবি। যারা ছিলেন আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত। তারা আমল করছেন আল্লাহর কথার উপর। আখিরাতের প্রস্তুতির জন্য। আল্লাহ বলেছেন¾

(وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ)

‘তোমরা ধাবমান হও তোমাদের প্রভুর ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে। যে জান্নাতের আয়তন আসমান-জমিন সমান। যা প্রস্তুত করা হয়েছে কেবল খোদাভীরুদের জন্য’। [সুরা আল-ইমরানঃ ১৩৩]

তিনি আরো বলেন..

(سَابِقُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ)

‘তোমরা তোমাদের প্রভুর ক্ষমা এবং জান্নাতের জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হও’। [সুরা হাদিদঃ ২১]

রাসুলের প্রিয় দুই সাহাবি সে কথাই বাস্তবায়িত করছিলেন অক্ষরে অক্ষরে। অথচ তাদের মর্যাদা ছিল কত উচ্চ। জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েও আখিরাতের প্রস্তুতি গ্রহণে তাঁরা একটুও অবহেলা করেননি।

৪.

প্রিয় সাহাবায়ে কেরাম আমাদের জন্য কষ্টিপাথরস্বরূপ। আমাদের জীবনকে তাদের জীবনের ছাঁচে গড়ে তুলার কথা বলেছেন প্রিয় রাসূল। আসুন একটু  মিলিয়ে দেখি আমাদের জীবনকে তাদের জীবনের সাথে। তাদের আখিরাতের প্রস্তুতির সাথে মিলাই আমাদের আখিরাতের প্রস্তুতিকে। মিলিয়ে কী পেলাম। আখিরাতের প্রস্তুতি নিতে যে মহাসাগরের প্রয়োজন তার একটি ফোঁটাও কি আমাদের ঝুলিতে আছে? আমরা ভুলে গেছি কেন এসেছি দুনিয়ায়? আমরা দুনিয়ায় এসেছি কি দুনিয়াকে আবাদ করার জন্য? না। আমরা দুনিয়ায় এসেছি আখিরাতকে আবাদ করার জন্য। কারণ,

(الدنيا مزرعة الآخرة)

‘দুনিয়া আখিরাতের চাষভূমি’।

আমরা দুনিয়াতে যত নেক-আমলের চাষ করব, আমাদের আখিরাত হবে ততই সমৃদ্ধ। রাসুলের প্রিয় দুই সাহাবির সাথে আমাদের অবস্থাকে মিলিয়ে নেই। জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েও আখিরাতের প্রস্তুতি গ্রহণে তাদের কী উৎকণ্ঠা! নেক-আমলের বিপুল ভাণ্ডার নিয়েও গুনাহের চিন্তায় তারা হয়ে যান কতটা সংকুচিত। তাদের তুলনায় আমরা তো কপর্দকহীন।

আমাদের ঝুলিতে যত নেকী আছে, গুনাহ আছে তার কয়েকগুন। তবুও আমরা অবহেলায় মত্ত হয়ে আছি। সংক্ষিপ্ত পৃথিবীর জীবনকে সমৃদ্ধ করতে গিয়ে ভুলে গেছি অনন্তকালের জীবন আখিরাতকে। অথচ মৃত্যু এই বুঝি এসে কড়া নাড়ল আমার দুয়ারে। মৃত্যু এসে গেলেই ধুলির শরীরে মিশে যাবে আমাদের যত স্বপ্ন। জীবনকে সমৃদ্ধ করার যত প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। তাই মৃত্যুর আগে হিসাব গ্রহণ করুন নিজের। দেখুন নেক আমলের চারাটির কী খবর? তা কি শুষ্ক হয়ে আছে? নাকি নিঃশেষ হয়ে গেছে? চেষ্টা করুন সেই বৃক্ষটিকে সজীবতা দিতে। মূলোৎপাটন করুন গুনাহের বৃক্ষের। তওবার করাত দিয়ে কেটে ফেলুন মহীরুহের আকার ধারণ করা গুনাহের বৃক্ষটিকে। শহরে মহামারী আসুক বা না আসুক। মৃত্যু আসবেই। মৃত্যু আসবেই। তাই মরার আগে মৃত্যুকে করুন মধুর। যেমন মৃত্যু হয়েছিল আমাদের সালাফের। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।

اللهم أرزقني قبل الموت توبة وعند الموت شهادة وبعد الموت جنة

اللهم إني أعوذ بك من فتن الدنيا

সুত্রঃ তারিখু ইবনি আসাকির: 30/322

Facebook Comments

Related posts

মানসিক দুঃখ-কষ্টের কারণ ও প্রতিকার | আব্দুল্লাহ তালহা

সংকলন টিম

দরবেশ মুজাহিদ | আহমাদ উসমান

৯৯ কুফর ও এক ঈমান: ওলামায়ে দেওবন্দ কী বলে? | আব্দুল্লাহ বিন বশির

সংকলন টিম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!