সংকলন
খলিফা-মু’তাসিম
ইতিহাস জীবনী মাহমুদ সিদ্দিকী

খলিফা মু’তাসিম কর্তৃক আব্বাজানকে নির্যাতন | সালেহ ইবনে আহমাদ ইবনে হাম্বল

আব্বাজান বলেন, “রমযানের উনিশ দিন গত হলে একটি হাতকড়া পরিয়ে আমাকে কারাগার থেকে ইসহাক ইবনে ইবরাহিমের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ইসহাক প্রতিদিন আমার কাছে দুজন লোক পাঠাত”। সালেহ বলেন, আব্বাজান তাদের দুজনের নাম বলেছেন; একজন হলেন আহমদ ইবনে রাবাহ, অপরজন আবু শুয়াইব আল-হাজ্জাম।

এই দুজন আমার সাথে কথা বলত, মুনাযারা করত। যখন তাদের ফিরে যাওয়ার সময় হতো, তখন প্রহরী ডেকে আমার হাতে একটি হাতকড়া এবং পায়ে চারটি বেড়ি পরিয়ে রেখে যেতো। এই অবস্থায় আমি তিনদিন অতিবাহিত করি।

জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে বসে কথা বলার সময় একদিন দুজনের একজন আমার সাথে কথা বলছিল। আল্লাহর ইলম সম্পর্কে আমি তার আকিদা জানতে চাইলাম।

‘আল্লাহর ইলম সৃষ্ট (মাখলুক)’। লোকটি উত্তর দেয়।

‘আরে কাফের, তুমি তো কুফরি করেছ’! বললাম আমি।

‘এখানে আমিরুল মুমিনিনের দূত উপস্থিত আছেন’। ইসহাকের পক্ষ থেকে দূত হিসেবে যে-লোকটি আলোচনায় উপস্থিত থাকত সে যেন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করল।

‘নিঃসন্দেহে এ কুফরি করেছে’। প্রত্যুত্তরে বললাম আমি।

অপর আলোচক তখন বাইরে ছিল। সে এলে বললাম, ‘এ দাবি করেছে—আল্লাহর ইলম মাখলুক’। শুনে সে সঙ্গীর দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর চলে যায়।

আব্বাজান বলেন, আল্লাহর নামসমূহ কুরআনে রয়েছে। আর কুরআন হলো আল্লাহর ইলম। সুতরাং যে দাবি করবে কুরআন মাখলুক, সে কাফের হয়ে যাবে; যে দাবি করবে আল্লাহর নামসমূহ মাখলুক, সেও কাফের হয়ে যাবে।

চতুর্থ দিন ইশার পর মু’তাসিম আমাকে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে ইসহাকের কাছে একজন নির্যাতক পাঠায়। প্রথমে ইসহাকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ইসহাক বলে—‘আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি আহমদ, প্রাণের মায়া করুন! খলিফা হলফ করেছেন, আপনাকে তরবারি দিয়ে হত্যা করবেন না। তিলে-তিলে নির্যাতন করে শেষ করবেন। এমন এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করবেন, যেখানে সূর্যের আলো পাবেন না। আল্লাহ তাআলা কি বলেননি—(إنا جعلناه قرآنا عربيا) ‘নিশ্চয় আমি একে বানিয়েছেন আরবি কুরআন’; কোনো কিছু মাখলুক হওয়া ছাড়া কি বানানো যেতে পারে’?

‘আল্লাহ তাআলা তো এও বলেছেন— (فجعلهم كعصف مأكول) “অতঃপর তিনি তাদেরকে বানিয়ে দিলেন প্রাণীতে খেয়ে ফেলা ঘাসের ন্যায় নিশ্চিহ্ন”। আল্লাহ কি তাহলে তাদেরকে ঘাস বানিয়ে সৃষ্টি করেছেন’? পাল্টা প্রশ্ন করলাম আমি।

ইসহাক একথা শুনে নির্দেশ দিল— ‘নিয়ে যাও একে’।

আব্বাজান বলেন, এরপর আমাকে নিয়ে রওয়ানা হয়। দজলার তীরবর্তী নিম্নভূমি বাবুল বুস্তানে যাত্রাবিরতি করা হয়। আমার সাথে ছিল প্রধান নির্যাতক এবং ইসহাকের পক্ষ থেকে পাঠানো একজন দূত।

নির্যাতক তখন প্রহরী মুহাম্মদকে ফারসিতে জিজ্ঞেস করে, ‘এই লোকের কাছ থেকে তোমরা কী চাও’?

‘কুরআন মাখলুক (নশ্বর)—খলিফার লোকেরা তাকে দিয়ে একথা বলাতে চায়’। উত্তর দেয় প্রহরী।

‘তিনি কেবল এটুকুই বলেন জানি—লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ এবং আমিরুল মুমিনিন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটাত্মীয়’। প্রতিউত্তরে নির্যাতক বলে।

আব্বাজান বর্ণনা দেন, তীরে পৌঁছলে আমাকে বজরা থেকে বের করে এনে একটি বাহনে আরোহণ করানো হয়। হাতে-পায়ে তখন বেড়ি পরানো। আমাকে যে ধরে রাখবে, এমন কেউ সাথে নেই। বারবার নিজের চেহারার ওপর হুমড়ি খেয়ে-খেয়ে পড়তে থাকি। এভাবে একসময় বাহন আমাকে নিয়ে দ্বারে পৌঁছে। এরপর ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে আবার বের করে অন্য এক প্রকোষ্ঠে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানকার এক ঘরে আমাকে রেখে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে দেওয়া হয়। দরজায় নিয়োগ দেয় একজন প্রহরী। তখন মধ্যরাত। ঘরে কোনো বাতি নেই। উযুর প্রয়োজন দেখা দিলে হাত বাড়িয়ে কিছু পাওয়ার আশায় খুঁজতে থাকি। সৌভাগ্যক্রমে দেখি একটি পাত্রে পানি ও চিলুমচি রাখা। তারপর প্রস্তুতি নিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে যাই। সকাল হলে দূত আসে। হাত পাকড়াও করে মূল গৃহে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখি খলিফা মু’তাসিম বসা। ইবনে আবি দুআদও উপস্থিত। আরও কিছু সঙ্গীসাথিকে সে একত্র করেছে। ঘর কানায়-কানায় ভরপুর। আমি কাছে গিয়ে খলিফাকে সালাম দিই। খলিফা বলেন, আহমদকে কাছে নিয়ে এসো। কাছে নিতে-নিতে একদম নিকটে চলে যাই। তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, বসুন। আমি বসে পড়ি। ইতিমধ্যে বেড়িগুলো আমাকে ভারাক্রান্ত করে ছেড়েছে। সামান্য সময় চুপ থেকে আমি কথা শুরু করলাম— ‘কথা বলার অনুমতি দিবেন কি’?

‘বলুন’। খলিফা বললেন।

-‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কীসের দাওয়াত দিয়েছেন’?

-‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই—এই সাক্ষ্য প্রদানের’।

-‘তাহলে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই’।

আব্বাজান বলেন, তারপর বললাম, ‘আপনার পূর্বপুরুষ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন যে, আব্দুল কায়স গোত্রের প্রতিনিধি দল যখন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসে, তখন নবিজি তাদেরকে আল্লাহ তাআলার প্রতি ইমান আনার নির্দেশ দেন। তারপর জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কি জানো ইমান কী? তারা উত্তর দেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ভালো জানেন। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এই সাক্ষ্য দেওয়া যে—আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ তাঁর রাসুল, নামাজ কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, রমযানের রোযা রাখা এবং গনিমতের পঞ্চমাংশ দান করা।

মু’তাসিম তখন আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আমার পূর্ববর্তী যিনি ছিলেন, আপনাকে যদি তার হাতে গ্রেফতার না পেতাম, তাহলে আপনার সামনে এই পরীক্ষা উপস্থাপন করতাম না’। তারপর আব্দুর রহমান ইবনে ইসহাকের দিকে ফিরে তার উদ্দেশে বললেন, ‘আব্দুর রহমান, মিহনাহ (পরীক্ষা) উঠিয়ে নিতে আমি কি তোমাকে নির্দেশ দিইনি’?

মনে-মনে বললাম, ‘আল্লাহু আকবার, নিঃসন্দেহে এতে মুসলিমদের স্বস্তি লাভ হবে’।

তারপর খলিফা বললেন, ‘তোমরা তার সাথে কথা বলো এবং মুনাযারা করো। আব্দুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আব্দুর রহমান, তুমি কথা বলো’।

‘কুরআনের ব্যাপার আপনি কী বলেন’? আব্দুর রহমান আমাকে জিজ্ঞাসা করে।

‘আল্লাহর ইলমের ব্যাপারে আপনি কী বলেন’? আমি পাল্টা জিজ্ঞাসা করি, তখন সে চুপ হয়ে যায়।

তারপর একে-একে সবাই আমার সাথে কথা বলতে থাকে এবং আমি জবাব দিতে থাকি। তারপর বলি, আমিরুল মুমিনিন, আপনার মতের স্বপক্ষে কুরআন কিংবা হাদিস থেকে কোনো দলিল আমাকে দিন, যার প্রবক্তা আমি হব।

‘কিন্তু আপনি তো তখন বলেন—কুরআন কিংবা হাদিসে যেভাবে আছে সেটাই আমার কথা’। ইবনে আবি দুআদ আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে।

‘দেখুন, আমি একটি (তাবিল) ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়েছি। আর আপনি ভালোভাবেই অবগত আছেন, আমি এমন কোনো তাবিল করিনি, যার অপরাধে হাতে-পায়ে বেড়ি পরিয়ে বন্দি করে রাখা হবে’। উত্তর দিই আমি।

তখন ইবনে আবি দুআদ বলে, ‘কসম খোদার আমিরুল মুমিনিন, সে নিজে পথভ্রষ্ট, অন্যকে বিভ্রান্তকারী এবং বিদআতি। এই যে আপনার খেলাফতের বিচারক ও ফকিহগণ উপস্থিত, তাদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখুন’।

‘আপনারা কী বলেন’? মু’তাসিম উপস্থিত লোকদেরকে জিজ্ঞেস করেন।

‘আমিরুল মুমিনিন, সে ভ্রষ্ট, অন্যকে বিভ্রান্তকারী এবং বিদআতি’। উত্তর দেন তারা।

আব্বাজান বলেন, তারা আমার সাথে কথা চালিয়ে যেতে থাকে। আস্তে-আস্তে আমার আওয়াজ তাদের আওয়াজের ওপর উচ্চকিত হতে শুরু করে।

‘আল্লাহ তাআলা বলেছেন, (ما يأتيهم من ذكر من ربهم محدث) “তাদের কাছে তাদের রবের পক্ষ থেকে নতুন যিকর আসে…” মাখলুক না হয়ে নতুন হয় কীভাবে’? মুনাযিরদের একজন আমাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন ছোড়ে।

‘আল্লাহ তাআলা বলেছেন, (ص، والقرآن ذي الذكر) “ছাদ, শপথ উপদেশসমৃদ্ধ কুরআনের”। এই আয়াতে যিকর অর্থ কুরআন। কিন্তু ওই আয়াতে যিকর অর্থ কুরআন নয়। কারণ, সেখানে যিকরকে কুরআনের অর্থে নির্দিষ্টকরণের আলিফ-লাম নেই’। জবাব দিই আমি।

ইবনে সামাআ আমার কথা বুঝতে পারছিল না। অন্যদেরকে জিজ্ঞেস করতে লাগল— আহমদ কী বলছে? অন্যরা তাকে বুঝিয়ে দিল—আহমদ এমন-অমন বলছে।

ওই মুহূর্তে তাদের একজন খাব্বাব রাযিয়াল্লাহু আনহুর এই হাদিসটি উল্লেখ করল—‘হায় তুচ্ছ পৃথিবী! যেভাবে পারো আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করো। তবে নিঃসন্দেহ থাকো, কিছুতেই কুরআনের চেয়ে অধিক প্রিয় কিছু দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারবে না’।

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, এমনই বিষয়টি’।

ইবনে আবি দুআদ তখন ক্রোধান্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতে লাগল।

‘আল্লাহ কি বলেননি— (خالق كل شيء) “তিনি সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা”? কেউ একজন প্রশ্ন করল।

‘আল্লাহ এও বলেছেন, (تدمر كل شيء) “ঝড় আপনার রবের নির্দেশে সবকিছুকে ধ্বংস করে দিবে”। সুতরাং আমি আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত বাকি সব শেষ করে দিয়েছি’। উত্তরে বললাম আমি।

আলোচনার মধ্যে কেউ একজন কথা বলতে গিয়ে ইমরান ইবনে হুছাইনের হাদিসটি উল্লেখ করে— (إن الله تبارك و تعالى كتب الذكر) “নিশ্চয় আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলা কুরআন লিপিবদ্ধ করেছেন”। এর পরিবর্তে সে বলে— (إن الله خلق الذكر) “নিশ্চয় আল্লাহ কুরআন সৃষ্টি করেছেন”।

আমি বললাম, এটা ভুল। একাধিক ব্যক্তি আমার কাছে বর্ণনা করেছেন— (كتب الذكر) “কুরআন লিপিবদ্ধ করেছেন”।

লোকটি নিবৃত হলে ইবনে আবি দুআদ কথা বলতে শুরু করে। মধ্যাহ্ন ঘনিয়ে এলে খলিফা সবাইকে চলে যেতে বলেন। আব্দুর রহমান ইবনে ইসহাককে রেখে দেন। তারপর আমাকে ও আব্দুর রহমানকে নিয়ে একান্ত মজলিসে বসেন। আমাকে লক্ষ করে বলতে থাকেন, ‘সালেহ আর-রাশিদিকে চিনতেন না? আমার শিক্ষক ছিলেন। এই জায়গায় বসে ছিলেন’। বলে ঘরের এক দিকে হাত দিয়ে দেখান। ‘তিনি কথা বলতে গিয়ে কুরআনের নশ্বরতার কথা আলোচিত হলে আমার সাথে ভিন্নমত প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে আমার নির্দেশে তাকে বরখাস্ত করে পদদলিত করা হয়’।

তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনাকে ঠিক চিনি না। আপনি কি দরবারে আসতেন না’?

‘আমিরুল মুমিনিন, আমি তাকে ত্রিশ বছর ধরে চিনি। আপনার প্রতি আনুগত্য রাখে, আপনার সাথে হজ ও জিহাদে শরিক হতে বলে। তবে সে সার্বক্ষণিক বাড়িতে থাকে’। আব্দুর রহমান উত্তরে বলে।

খলিফা তখন বলতে থাকেন, ‘আল্লাহর শপথ, সন্দেহ নেই সে ফকিহ, নিঃসন্দেহে সে আলিম। তার মতো ব্যক্তি আমার সঙ্গে থাকবে—এটা আমাকে আনন্দ দেয়। আমার হয়ে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জবাব দেবে। যদি সে এতটুকুও সমর্থন দেয়, যাতে সামান্য স্বস্তি দেওয়া যেতে পারে, তাহলে নিজ হাতে আমি তাকে মুক্ত করে দেবো। আমি নিজে তার শাস্তি রহিত করব। তার সম্মানে আমি সেনাবাহিনী নিয়ে উপস্থিত হব’।

‘তোমার জন্য আক্ষেপ হয় আহমদ! কী বলো তুমি’? আমার দিকে ফিরে বললেন খলিফা।

আব্বাজান বলেন, ‘আমি বলি আমিরুল মুমিনিন, আপনারা কুরআন কিংবা হাদিস থেকে এর স্বপক্ষে কোনো দলিল দিন’।

মজলিস দীর্ঘ হতে থাকলে খলিফা বিরক্ত হয়ে উঠে যান। যেখানে পূর্বে ছিলাম আমাকে আবার সেখানে ফিরিয়ে আনা হয়। তারপর দুজন লোক পাঠান, যাদের নাম তিনি নিজে বলে দেন। একজন হলেন শাফেয়ির ছাত্র, অপরজন গাসসান, ইবনে আবি দুআদের ছাত্র। তারা আমার সাথে মুনাযারা করেন এবং আমার সাথে অবস্থান করেন। ইফতারের সময় হলে আমাদের কাছে খাদ্যসহ একটি দস্তরখান পাঠানো হয়। তারা দুজন খেতে থাকে আর আমি অজুহাত দেখিয়ে খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত থাকি। পরে দস্তরখান উঠিয়ে নেওয়া হয়। ওই দুজন পরদিন পর্যন্ত আমার কাছে অবস্থান করে।

এর ফাঁকে ইবনে আবি দুআদ একবার এসে জানতে চায়—‘আহমদ, আমিরুল মুমিনিন আপনার কাছে জানতে চান—আপনি কী বলেন’?

‘আপনি কুরআন কিংবা হাদিস থেকে এর স্বপক্ষে কোনো দলিল দিন, যাতে করে এর প্রবক্তা হতে পারি’। আমি উত্তর দিই।

তখন ইবনে আবি দুআদ বলে, ‘আল্লাহর শপথ, খলিফা বিশেষ সাতজনের তালিকায় আপনার নাম লিখেছিলেন। কিন্তু আপনি নিজে সেটা মুছে দিলেন। আপনার মতো ব্যক্তিদেরকে গ্রেফতার করতে আমার কষ্ট হয়। আল্লাহর কসম, খলিফা আপনাকে তরবারি দিয়ে মারবেন না। বরং কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি দিয়ে মারবেন’। তারপর আবার জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কী বলেন’? আমি পূর্বের মতোই জবাব দিই। তারপর খলিফার দূত এসে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি যার কামরায় ছিলেন তার ভাই আহমদ ইবনে আম্মার কোথায়’? সে ভেতরে গিয়ে ফিরে এসে আবার বলে, ‘আমিরুল মুমিনিন জানতে চান— আপনি কী বলেন’? ইবনে আবি দুআদকে যেমন জবাব দিয়েছিলাম, তাকেও তাই দিই। খলিফার দূত একের পর এক আসতে থাকে। আহমদ ইবনে আম্মার খলিফা ও আমার মাঝে দূত হিসেবে আসা-যাওয়া করত। সে বলে, ‘খলিফা আপনার উদ্দেশে বলেছেন, আপনি কুরআন মাখলুক হওয়ার বক্তব্যে সমর্থন দিন। তাহলে আমি নিজ হাতে আপনাকে মুক্ত করে দেবো’।

দ্বিতীয় দিন এলে আমাকে খলিফার নিকট নিয়ে যাওয়া হলো। খলিফা নির্দেশ দিলেন, ‘কথা বলো তার সাথে; মুনাযারা করো’।

তারা একের পর এক কথা বলতে থাকে। এদিক থেকে এ, ওদিক থেকে ও। আমিও একে-ওকে জবাব দিতে থাকি। তারা যখন এমন কোনো দলিল উপস্থাপন করে, যা কুরআন-হাদিসে নেই, কিংবা এ ব্যাপারে সাহাবা-তাবেয়িনের মন্তব্য নেই, তখন বলি—‘আমি জানি না এটা কী’।

‘আমিরুল মুমিনিন, যখন আমাদের বিরুদ্ধে কোনো দলিল তার সামনে আসে তখন লাফিয়ে ওঠে। আর আমরা যখন কোনো দলিল দিয়ে কথা বলি তখন বলে— এটা কী আমি জানি না’। খলিফার কাছে তারা অভিযোগ জানায়।

—‘মুনাযারা চালিয়ে যাও’। খলিফা শুনে নির্দেশ দেন। তারপর বলেন, ‘আহমদ, সত্যি আমি আপনার প্রতি সদয়’।

—‘আমার ধারণা, আপনি হাদিস উল্লেখ করে নিজের পক্ষে চালিয়ে দেন’। একজন বলে উঠল।

—‘এই আয়াত সম্পর্কে আপনি কী বলেন— (يوصيكم الله في أولادكم، للذكر مثل حظ الأنثيين) আল্লাহ তোমাদেরকে অসিয়ত করছেন তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে; পুরুষের মিরাস নারীর অংশের দ্বিগুণ’? তাকে জিজ্ঞেস করলাম।

—‘আল্লাহ এই আয়াত মুমিনদের সাথে খাস করেছেন’। উত্তরে দেয় লোকটি।

—যদি সে হত্যাকারী হয় কিংবা কোনো ইহুদি বা খ্রিষ্টান গোলামকে হত্যা করে, তাহলে’? পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম।

এবারে সে নীরব হয়ে যায়।

আব্বাজান বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে এই বিষয়ক দলিল দিয়ে খামোশ করেছি; কারণ তারা আমার বিরুদ্ধে কুরআনের বাহ্যিক অর্থ দিয়ে দলিল দেয়। দ্বিতীয় কারণ হলো তার এই বক্তব্য—আমার ধারণা আপনি হাদিস নিজের পক্ষে চালিয়ে দেন’।

তাদের আলোচনা সমাপ্ত হলে ইবনে আবি দুআদ কথা বলতে শুরু করে। সে বলে, ‘আমিরুল মুমিনিন, আহমদ যদি আপনার মতবাদে সমর্থন দেয়, তাহলে সেটা আমার কাছে লাখ-লাখ দিনারের চেয়েও বেশি প্রিয় হবে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে সেসব পুনরায় দিয়ে দিবেন’।

তারপর খলিফা সবাইকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে আমাকে ও আব্দুর রহমানকে নিয়ে একান্ত বৈঠকে বসলেন। একই কথা ঘুরেফিরে বারবার হয়। এর মাঝে মু’তাসিম জিজ্ঞেস করেন, ‘আহমদ ইবনে আবি দুআদকে ডাকবেন’? আমি বলি, ‘সেটা আপনার ইচ্ছে’। ইবনে আবি দুআদকে ডেকে পাঠালে সে এসে কথা বলতে থাকে। মজলিস দীর্ঘ হতে থাকলে খলিফা উঠে চলে যান এবং আমাকেও পূর্বের স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।

গতকাল যে-দুজন লোক আমার কাছে ছিল, তারা এসে আলোচনা করতে থাকে। বারবার ঘুরেফিরে একই কথা হতে থাকে। ইফতারের সময় হলে প্রথম রাতের মতোই ইফতার নিয়ে আসা হয় এবং আমি অজুহাত দেখাই। একের পর এক দূত আসতে থাকে আহমদ ইবনে আম্মারের কাছে; আর সে পাঠিয়ে দেয় আমার কাছে। প্রথম রাতের মতোই তারা খলিফার বার্তা নিয়ে আসে।

ইবনে আবি দুআদ এসে বলল, ‘খলিফা হলফ করেছেন—আপনাকে কঠিন থেকে কঠিনতম প্রহার করবেন এবং এমন এক জায়গায় বন্দি করে রাখবেন, যেখানে সূর্য দেখতে পাবেন না’।

‘তাহলে আমি কী করতে পারি’? উত্তর দিলাম।

সময় তখন প্রায় ভোর। মনে-মনে বললাম, আজকে আমার বিষয়ে একটি কিছু ঘটবেই। পায়জামার ফিতা বের করে ফেললাম। তারপর যে-বেড়িগুলো যাওয়ার সময় বহন করতে হবে, সেগুলো ফিতা দিয়ে বাঁধলাম। দায়িত্বশীলদের সাথে থাকা একজনকে বললাম, আমাকে একটা দড়ি দিন। লোকটি দড়ি দিল। তারপর দড়ি দিয়ে বেড়িগুলোকে বেঁধে ফিতা পায়জামাতে লাগিয়ে ফেললাম। এমন কিছু করে কি না যার ফলে বিবস্ত্র হয়ে যেতে হয়—এই আশঙ্কায় ভালো করে পায়জামা পরলাম।

তৃতীয় দিন এলে সকলের উপস্থিতিতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। এঘর থেকে ওঘরে যেতে থাকি। দেখি—একদলের হাতে তরবারি, আরেকদলের সাথে চাবুক। এছাড়াও বিভিন্ন ইউনিফর্ম ও অস্ত্র। ঘরে সেনাবাহিনী জমায়েত হয়েছে। গত দুইদিন এত অস্ত্রধারী লোক ছিল না। অবশেষে খলিফার কাছে নিয়ে যাওয়া হলে অন্যান্য দিনের মতো বলেন, ‘কথা বলো তার সাথে; মুনাযারা করো’। পূর্বের মতো তারা পুনরায় মুযাকারা করে। ঘুরেফিরে একই কথা বারবার হয়। যখন আমার সাথে একান্ত বৈঠকে যাওয়ার সময় হয়, খলিফা সকলকে জমা করে পরামর্শ করেন। তারপর সবাইকে সরিয়ে দেন। আমাকে ও আব্দুর রহমানকে নিয়ে একান্ত বৈঠকে বসেন।

—‘ধিক আহমদ, কসম আল্লাহর, আমার ছেলে হারুনের মতো আপনার প্রতি আমি সদয়। মেনে নিন আমার কথা’। খলিফা আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন।

—‘আমিরুল মুমিনিন, আপনারা আমাকে কুরআন কিংবা হাদিস থেকে এর স্বপক্ষে কোনো দলিল দিন’। শান্তস্বরে জবাব দিই।

মজলিস দীর্ঘ হলে খলিফা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তোমার ওপর আল্লাহর লা’নত। আমি তোমার ব্যাপারে আশান্বিত হয়েছিলাম। পাকড়াও করো একে এবং টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাও’।

আমাকে পাকড়াও করে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। খুলে ফেলা হয় পরনের জামা। তারপর খলিফা নির্দেশ দেন, ‘দুটো শ্যেনসদৃশ কাঠ এবং চাবুক নিয়ে এসো’। খলিফার নির্দেশমতো নিয়ে আসা হয়।

আমার কাছে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি অথবা দুইটি চুল ছিল। সেগুলো জামার আস্তিনে রেখে দিই। ব্যাগের ভেতর রাখা জামার আস্তিনে ইসহাক ইবনে ইবরাহিমের চোখ পড়ে। জিজ্ঞেস করে, ‘এই ছোট ব্যাগে কী? তোমার জামার আস্তিন দেখাও’।

—‘নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি চুল’। উত্তর দিই আমি।

আমাকে যে-মুহূর্তে দুই শ্যেনকাঠের মাঝখানে বাঁধা হচ্ছে, সেসময় কয়েকজন জামাটি পোড়ানোর জন্য নিয়ে যায়। তখন মু’তাসিম তাদেরকে বলেন, ‘কাপড় পোড়ো না। তার কাছ থেকে নিয়ে নাও’।

আমার ধারণা, জামার আস্তিনে থাকা চুলটির কারণে খলিফা জামা পোড়াতে বাধা দেন।

তারপর আমাকে দুই শ্যেনকাঠের মাঝখানে রেখে দুই হাত বাঁধা হয়। একটি কুরসি নিয়ে আসা হয়। খলিফা সেখানে বসেন। ইবনে আবি দুআদ তখন খলিফার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। উপস্থিত লোকেরা দাঁড়িয়ে দেখছে। আমাকে যারা বেঁধেছে তাদের একজন বলল, কাঠের গুঁড়িদুটিকে ভালো করে আঁকড়ে ধরে থাকুন। কিন্তু আমি তার কথা বুঝতে পারিনি; যার দরুন কাঠদুটি ধরতে পারিনি। বাঁধার সময় আমার দুই হাত খুলে যায়।

আবুল ফযল বলেন, ইন্তেকাল পর্যন্ত আব্বাজান দুই হাতের ব্যথা অনুভব করতেন।

তারপর মু’তাসিম জল্লাদদেরকে নির্দেশ দেন, ‘যাও’। পরক্ষণেই চাবুকের দিকে খেয়াল করেন। নির্দেশ দেন, ‘এগুলো পাল্টে আনো’। পাল্টে আনা হলে আঘাতের নির্দেশ দেন।

—‘যাও, আঘাত করো! আল্লাহ ওর হাতকে কেটে ফেলুন’! প্রথম জল্লাদকে নির্দেশ দেন মু’তাসিম।

সে অগ্রসর হয়ে আমাকে দুইবার চাবকায়। তারপর সরে যায়।

এরপর দ্বিতীয় জল্লাদকে নির্দেশ দেন—‘যাও, আঘাত করো! আল্লাহ ওর হাতকে নির্মমভাবে কেটে ফেলুন’!

জল্লাদ এগিয়ে এসে দুইবার চাবকে সরে যায়।

মু’তাসিম এভাবে একের পর এক জল্লাদকে ডাকতে থাকেন। প্রত্যেকে দুইটি করে চাবুক মেরে সরে যেতে থাকে। তারপর খলিফা উঠে আমার দিকে এগিয়ে আসেন। জল্লাদরা চারদিক থেকে ঘিরে আছে।

—‘ধিক আহমদ! নিজেকে কি মেরে ফেলবে? ধিক তোমায়! আমার কথা মেনে নাও, নিজ হাতে তোমাকে মুক্ত করে দেবো’। খলিফা বলেন আমাকে।

—‘ধিক, তোমার নেতা তোমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে’। কেউ-কেউ বলতে লাগল।

—‘তুমি কি এদের সবাইকে হারিয়ে দিতে চাও’? জনৈক কাপুরুষ তরবারির বাঁট দিয়ে খোঁচা মেরে বলল।

—‘ধিক তোমায়, খলিফা তোমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে’! ইসহাক ইবনে ইবরাহিম বলতে লাগল।

—‘আমিরুল মুমিনিন, তার রক্তের দায় আমার ঘাড়ে’। কেউ একজন বলল।

খলিফা কুরসিতে ফিরে গিয়ে জল্লাদকে ফের নির্দেশ দেন, ‘যাও, প্রহার করো। আল্লাহ তোমার হাত দ্বিখণ্ডিত করে ফেলুন’।

তারপর একের পর এক জল্লাদ ডাকতে থাকলেন। প্রত্যেকে দুইটি করে চাবুক মেরে সরে যেতে থাকে। আর খলিফা বলতে থাকেন, ‘আরও জোরে মারো! আল্লাহ তোমার হাত কেটে ফেলুন’!

তারপর দ্বিতীয়বার আমার কাছে উঠে এলেন। বলতে লাগলেন, ‘মেনে নাও আহমদ’!

আব্দুর রহমান ইবনে ইসহাক বলতে থাকল, ‘এই ব্যাপারে আপনি যে-আচরণ করছেন, এমন আচরণ আপনার সঙ্গীদের মধ্যে আর কে করেছে? এই যে ইয়াহইয়া ইবনে মাইন, আবু খাইসামা, ইবনে আবি ইসরাইল কুরআনের নশ্বরতা মেনে নিয়েছে’। আরও যারা মেনে নিয়েছে তাদের নাম সে বলতে থাকল।

—‘ধিক তোমায়! মেনে নাও’। খলিফা বলতে থাকলেন।

আর আমি আগে যেমন বলতাম তখনও তেমনই বলতে থাকলাম।

খলিফা পুনরায় কুরসিতে ফিরে জল্লাদকে নির্দেশ দেন, ‘যাও, প্রহার করো। আল্লাহ তোমার হাত কেটে ফেলুন’!

 

আমি মূর্ছা গেলাম। যখন জ্ঞান ফেরে তখন নিজেকে একটি কামরায় আবিষ্কার করি। হাতে-পায়ের বেড়ি খুলে রাখা হয়েছে। উপস্থিত একজন আমাকে বলল, আমরা আপনার মুখের ওপর ঝুঁকে আছি জ্ঞান ফেরার আশায়। আর পিঠের ওপর একটি কাঠ দিয়েছি।

আমি কোনোকিছু অনুভব করতে পারছিলাম না। তারা আমাকে যবের স্যুপ দিয়ে বলল, ‘খেয়ে নিন’। কিন্তু আমি বললাম, ‘রোযা ভাঙব না’। তারপর ইসহাক ইবনে ইবরাহিমের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

আব্বাজান বলেন, তখন যোহরের আযান হয়, আমরা যোহরের নামাজ পড়ি।

—‘আঘাত থেকে রক্ত বেয়ে-বেয়ে পড়ছে, এ অবস্থায় আপনি নামাজ পড়েছেন’? ইবনে সামাআ প্রশ্ন করল।

—এভাবে ওমর রা. নামাজ পড়েছেন; অথচ তাঁর জখম থেকে রক্ত ঝরছিল। জবাব শুনে সে চুপ হয়ে যায়।

সালেহ বলেন, তারপর আব্বাজানকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি বাড়িতে চলে আসেন। কারাগার থেকে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পাঠানো হয় আঘাত ও জখমগুলোর চিকিৎসা করার জন্য। আঘাত দেখে সে আমাদেরকে জানায়—‘কসম আল্লাহর, এত ভয়ানক চাবুকের আঘাত এর আগে আমি দেখিনি। সামনে এবং পিছন থেকে চাবুক মেরে টেনেছে। তারপর কোনো-কোনো জখমের গভীরে চলে গেছে’।

সে প্রতিদিন আসত চিকিৎসা করার জন্য। চেহারায়ও একাধিক জায়গায় আঘাত লেগেছিল। তারপর সে থেকে চিকিৎসা করতে থাকে। পরবর্তীতে একদিন আব্বাজান তাকে বলেন, ‘এই জায়গাটা কেটে ফেলতে চাই’। তখন চিকিৎসক লোহার টুকরা নিয়ে আসে। গোশতের সাথে লোহার টুকরাটিকে লাগিয়ে রেখে ছুরি দিয়ে কেটে ফেলতে থাকে। আব্বাজান ধৈর্য ধরতে থাকেন। এই অস্ত্রোপচারের জন্য আব্বাজান আল্লাহ তাআলার কাছে শুকরিয়া আদায় করেন। তারপর সুস্থ হয়ে ওঠেন। এরপরও কয়েক জায়গায় ব্যথা অনুভব করতেন। মৃত্যু পর্যন্ত আব্বাজানের পিঠে আঘাতের স্পষ্ট চিহ্ন ছিল।

আব্বাজানকে বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহর শপথ, অনেক কষ্ট দেওয়া হয়েছে আমাকে। আমি কামনা করি—এই বিষয় থেকে যেন পরিপূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে যাই। না আমার পক্ষে কিছু থাকে, আর না বিপক্ষে’।

মুনাযারার জন্য আব্বাজানের সাথে যে-দুজন ছিলেন তাদের একজন ছিলেন সাহিবে হাদিস। আব্বাজানকে ওই সময় দেখেছেন এবং শুনেছেন। তারপর আমার কাছে এসে বলেছেন—‘ওয়াল্লাহি, আমি তাঁর মতো আর কাউকে দেখিনি। যখন আমাদেরকে খাবার দেওয়া হতো তখন তাঁকে বলতাম, আবু আব্দুল্লাহ, আপনি রোযাদার। আছেনও এক ভয়সঙ্কুল জায়গায়। (সুতরাং কিছু খেয়ে নিন।) তিনি তখন পিপাসার্ত ছিলেন। পানির দায়িত্বশীলকে ডেকে বললেন, পানি দাও। সে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দিল। তিনি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ গ্লাসের দিকে তাকিয়ে থেকে ফিরিয়ে দিলেন, পান করলেন না। ভয় ও ক্ষুধা-পিপাসায় তাঁর সবর দেখে আশ্চর্য হতাম’।

সালেহ বলেন, এই দিনগুলোতে আমি উপায় খুঁজেছি এবং চেষ্টা করেছি আব্বাজানের খাবার অথবা এক-দুইটি রুটি পাঠানোর। কিন্তু পারিনি।

সেখানে উপস্থিত ছিল এমন আরেকজন আমাকে বিবরণ দেন, ‘এই তিনদিন আমি তাঁর খোঁজখবর নিয়েছি। তারা তাঁর সাথে মুনাযারা করত এবং আলাপ করত। কিন্তু তিনি কোনো ভুল করতেন না। আমার মনে হয় না তাঁর মতো সাহসিকতা ও দৃঢ়তা কারও আছে’।

আবুল ফযল সালেহ বলেন, একদিন আব্বাজানের ঘরে গেলাম। বললাম, ‘শুনেছি এক লোক ফযল আল-আনমাতির কাছে গিয়ে বলেছে, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন, যেহেতু আমি আপনার কোনো সাহায্য করতে পারছি না। তখন ফযল বলেছেন, আমি কাউকে ক্ষমা করি না’। আব্বাজান শুনে মৃদু হাসলেন। কিছুদিন পর যখন এই আয়াত পড়ি—‘যে ক্ষমা করে এবং মীমাংসা করে, তার প্রতিদান আল্লাহর যিম্মায়’; তখন এর তাফসির দেখলাম। দেখি সেখানে হাসান বসরির হাদিস, তিনি বলছেন—“যখন মানবজাতিকে কেয়ামত দিবসে আল্লাহ তাআলার সামনে পুনরুত্থিত করা হবে তখন ঘোষণা করা হবে—আল্লাহর যিম্মায় যাদের প্রতিদান রয়ে গেছে তারা যেন দাঁড়ায়। তখন একমাত্র তারাই দাঁড়াবে, যারা দুনিয়াতে অন্যকে ক্ষমা করেছে”।

আব্বাজান বললেন, ‘সুতরাং আমাকে প্রহারের দায় থেকে সকল মাইয়িতকে ক্ষমা করে দিলাম’। তারপর বলতে থাকলেন, ‘কারও ওপর কোনো দায় রইল না, যার কারণে আল্লাহ কাউকে শাস্তি দিবেন’।

Facebook Comments

Related posts

ফাতিমা আল-ফিহরি | পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা

সংকলন টিম

সংগ্রামী সাধক সেলাহ ইবনে উশাইম রহ. | মঈনদ্দীন তাওহীদ

সংকলন টিম

আফগানিস্তানের প্রথম বিজেতা: আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনু কুরাইজ । মাহদি হাসান

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!