সংকলন
আত্মশুদ্ধি আব্দুল্লাহ তালহা

মানসিক দুঃখ-কষ্টের কারণ ও প্রতিকার | আব্দুল্লাহ তালহা

( এ -বিষয়ক একটি আরবী বইয়ের ছায়ানুবাদ )
————————————————————————
মানসিক দুঃখ-কষ্টের কারণ হতে পারে বিবিধ।
কেউ মানসিক কষ্টে থাকে তার পাপের কারণে। কেউ বা দুঃখে থাকে এমন কোনো কারণে যা তার নিয়ন্ত্রণের বাহিরে। আবার অনেকে দুঃখ যাতনায় দিন যাপন করে তার প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে।
আবার এমন মানুষও এই জগতে আছে, যারা একেবারে তুচ্ছ ঠুনকো কারণে দুঃখের সাগরে ভাসতে থাকে।
.
এখানে আমরা মানসিক দুঃখ-কষ্টের বড় কয়েকটি কারণ তুলে ধরছি-

১/ আল্লাহ হতে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া:
এটা মানসিক অসুখ, দুঃখ বেদনার অন্যতম বড় কারণ। পাপাচারী ব্যক্তির জন্য দুনিয়া প্রশস্ত হওয়া সত্বেও সংকীর্ণ হয়ে যায়। যখন সে পাপাচারের অন্ধকারে হাবুডুবু খেতে থাকে তখন বিভিন্ন দুঃখ-কষ্ট ও পেরেশানি তার অন্তরকে আচ্ছন্ন করে রাখে।

– ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেছেন, পাপাচার ও গুনাহ মানসিক পেরেশানি ও অন্তরের দুঃখ বেদনার অন্যতম বড় কারণ। আল্লাহ হতে মুখ ফিরিয়ে রাখা বান্দা দুনিয়ার যত সুখ-সামগ্রীর মাঝেই থাকুক না কেন, সে দুঃখের সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকবেই।
তিনি আরো বলেন, পাপাচারের দুনিয়াবী আরো কিছু শাস্তি রয়েছে। তা হলো , পাপ অন্তরকে আল্লাহর প্রতি ধাবিত হওয়ার ক্ষেত্রে কঠোরভাবে বাধা প্রদান করে। তার মনে আখেরাতের চিন্তা-ফিকিরকে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে দেয় না। নিয়মিত পাপাচার অন্তরকে এক সময় হত্যা করে ফেলে, নয়তো অন্তরে এমন মারাত্মক ব্যধি সৃষ্টি করে যা তাকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়। পাপাচার ধীরে ধীরে মানুষের শক্তিও ধ্বংস করে দেয়।
পাপ অন্তরকে দুর্বল করতে করতে সেই আটটি বস্তু পর্যন্ত পৌঁছে দেয় যেগুলো থেকে রাসূলুল্লাহ সা. আল্লাহর নিকট আশ্রয় চেয়েছেন।
আল্লাহর রাসূল সা. দুআয় বলেছেন, ‘হে আল্লাহ আমি আপনার নিকট দুশ্চিন্তা, দুঃখ-যাতনা, অক্ষমতা, আলস্য, ভিরুতা ও কৃপণতা, ঋণের বোঝা ও মানুষ কর্তৃক জুলুমের শিকার হওয়া থেকে আশ্রয় নিচ্ছি’।

রাসূলুল্লাহ সা. এই আটটি জিনিস থেকে রবের নিকট পানাহ চেয়েছেন। কারণ এগুলো মানুষের দেহ-মন, জীবন সব ধ্বংস করে ছাড়ে।

এক ব্যক্তি হযরত সুফিয়ান বিন উয়াইনাহ রহ.কে জিজ্ঞেস করলেন, হুজুর! মনে অনেক কষ্ট। কিন্তু এর কারণ খুঁজে পাই না। হযরত সুফিয়ান বিন উয়াইনাহ বললেন, তা হলো সেই পাপের আছর, যা তুমি গোপনে করতে চেয়েছিলে, তবে করনি। এ-কারণে তোমার মনে কষ্ট হচ্ছে।

সুফিয়ান বিন উয়াইনাহর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে হযরত ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, পাপাচারের রয়েছে দুনিয়াবি শাস্তি। গোপনে করলে গোপন শাস্তি। প্রকাশ্যে করলে প্রকাশ্য শাস্তি।

ইবনুল জাওযি রহ. বলেন, যখনই আমি কোনো বিপদে পড়েছি বা আমার মনে দুশ্চিন্তা-পেরেশানি ও সংকট সৃষ্টি হয়েছে তখনই আমি বুঝতে পেরেছি আমার কোন অপরাধ বা পাপের কারণে এমন দুরাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি একেবারে সুনিশ্চিতভাবে বলতে পারতাম, ঐ পাপের কারণে আমি এই বিপদে বা সংকটে পড়েছি। এজন্য মানুষের উচিত পাপের শাস্তির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা। তাহলে সে সেই শাস্তি থেকে নিরাপদ থাকতে পারবে। আর তার কর্তব্য হলো তওবা করে যাওয়া।

ইবনুল কাইয়িম রহ. লিখেছেন, পাপের শাস্তি হলো, অন্তরে ঘোর অন্ধকার সৃষ্টি হওয়া। এই সমস্যার রহস্য এই যে, নেক আমল বান্দাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে। আর মানুষ আল্লাহর যত নিকটবর্তী হতে থাকে ততই তার আত্মিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। আর পাপাচার মানুষকে তার রব্ব থেকে অনেক দূরে হটিয়ে দেয়। সে ক্রমাগত যখন তার রব্ব থেকে দূরে সরে যেতে থাকে তখন তার মধ্যে অন্ধকারভাব আরো প্রগাঢ় হয়। এটাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সুরা তাহার ১২৩ নম্বর আয়াতে এভাবে বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি আমার যিকির থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে, তার জীবন হয়ে যায় সংকীর্ণ ও সংকটময়। এবং আমি তাকে কেয়ামতের ময়দানে অন্ধ করে ওঠাবো।
.
মানসিক দুঃখ পেরেশান্তির দ্বিতীয় কারণ:
দুনিয়ার বিপদ-মুসিবত। দুনিয়ার এই বিপদ-মুসিবতও কম নয়। কখনো প্রিয়জনের বিচ্ছেদ-বেদনা। কখনো দারিদ্রের কষাঘাত। কখনো বা অসুস্থতা অথবা অন্যায়-জুলুমের শিকার হওয়া। স্ত্রীর গোয়ার্তুমি বা স্বামীর জুলুম। ঘর-সংসারের প্রতি স্ত্রীর উন্নাসিকতা। সন্তানদের বখে যাওয়া। তাদের পিতা-মাতার সাথে অন্যায় আচরণসহ ইত্যকার বিভিন্ন বিপদ-মুসিবত।
.
তৃতীয় কারণ:
মানসিক চাপ বা কষ্টে ধৈর্যধারণের শক্তি হারিয়ে ফেলা। এটা হতে পারে ঘরের বিভিন্ন সমস্যার কারণে অথবা কর্মস্থলে মানুষের মন্দ আচরণের কারণেও হতে পারে।
মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি অনুযায়ী এই মানসিক সমস্যা কমবেশ হয়ে থাকে। কারণ অনেক ক্ষেত্রে মানুষ অন্যান্য মানুষের সাথে আচরণের নিয়মনীতিও জানে না, ফলে সমস্যার সম্মুখীন হয়ে যায়।
.
চতুর্থ কারণ:
জীবনের কোনো লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারিত না হওয়া। কেননা লক্ষ্যহীন মানুষ অথর্ব। যে ব্যক্তির জীবন চলার ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নেই তার সময়গুলো অহেতুক অনর্থক নষ্ট হতে থাকে। তার অন্তর সবসময় ভারাক্রান্ত থাকে। তার মনে থাকে ব্যাপক অশান্তি ও যাতনা।
বলুন তো এমন লোক কেন মানসিক কষ্টের শিকার হবে না! না হওয়ার তো কোনো কারণই নেই, বরং হওয়াই আবশ্যম্ভাবী।

পঞ্চম কারণ:
ছোটো ছোটো বিষয়কে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া। ক্ষুদ্র সমস্যাকে প্রকোট করে নিজেই নিজের মনকে পেরেশান করে রাখা। হাতে প্রয়োজন পূরণ করার মতো সামগ্রী থাকা সত্বেও এসব নিয়ে সবসময় দুশ্চিন্তায় পড়ে থাকা।

এ পর্যন্ত মানসিক অশান্তি পেরেশানির মোটামুটি মূল কয়েকটি কারণ নিয়ে আলোচনা করা হলো, সামনের পোস্টে এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের বিষয়ে আলোকপাত করা হবে ইনশাআল্লাহ।

Facebook Comments

Related posts

নির্মল জীবন-১২ | ইমরান রাইহান

ইতিকাফ: আত্মগঠনের দিবস দশক | সাদিক ফারহান

ইলম অর্জনের মুতাওয়ারাস ধারা | মাহমুদ সিদ্দিকী

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!